উদ্বেগ: ক্যানসার আক্রান্তের পরিজন। শুক্রবার চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটে। ছবি: রণজিৎ নন্দী
কারও কেমোথেরাপি আটকে, কারও রেডিয়োথেরাপি মাঝপথেই বন্ধ। কারও অস্ত্রোপচারের দিন ঠিক হয়েও পিছিয়ে যাচ্ছে। কেউ ওষুধ না-পেয়ে প্রতিনিয়ত যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। আবার কেউ বা গভীর অবসাদে ডুবে গিয়েছেন। যার জেরে শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে। সব মিলিয়ে রাজ্যের অসংখ্য ক্যানসার রোগী এবং তাঁদের পরিবার এই মুহূর্তে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার মুখে।
এমনকি, পৃথিবী জুড়ে সার্বিক অনিশ্চয়তার কথা শুনতে শুনতে রোগীদের এক অংশ নিজেদের পরিবার থেকে ‘বিচ্ছিন্ন’ বলে মনে করতে শুরু করেছেন, যা পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল করে তুলছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
রাজ্যের যাবতীয় চিকিৎসার অভিমুখ বর্তমানে মূলত কোভিড-১৯ কেন্দ্রিক হওয়ায় ক্যানসারের সার্বিক চিকিৎসা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ক্যানসার চিকিৎসকদের বড় অংশ জানাচ্ছেন, রোগের মাত্রা আলাদা হলেও সব ধরনের ক্যানসার রোগীর চিকিৎসাই বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত। যেমন, সবেমাত্র ক্যানসার ধরা পড়েছে, এখনই চিকিৎসা শুরু প্রয়োজন। অথচ তা করা যাচ্ছে না। রোগীদের অবস্থা বুঝে আপাতত হরমোনাল ট্যাবলেট-সহ ‘নন সার্জিকাল’, ‘নন রেডিয়েশন’ পদ্ধতি প্রয়োগের চেষ্টা চলছে। ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘ক্যানসার হয়েছে শুনলে এমনিতেই মানসিক বিপন্নতা শুরু হয়। সেখানে রোগ ধরা পড়েছে, অথচ চিকিৎসা করা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে চূড়ান্ত অসহায় অবস্থা রোগীদের!’’
আরও পড়ুন: অতিমারি শেষ হলে আবার দেখা হবে আমাদের, তখন নতুন পৃথিবীর মুখ দেখব?
আবার যাঁদের অস্ত্রোপচারের পরে রেডিয়োথেরাপি, কেমোথেরাপি শুরু হয়েছিল, সেগুলিও বর্তমানে আটকে রয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। জাতীয় স্তরে ক্যানসার চিকিৎসার একাধিক উৎকর্ষ কেন্দ্রের গাইডলাইন অনুযায়ী ‘ইমার্জেন্সি’ ছাড়া ক্যানসারের বাকি চিকিৎসা পিছোনো হয়েছে।
আরও পড়ুন: করোনাযুদ্ধ: ভিডিয়ো ছেড়ে ডেরেকের জবাব বিরোধীদের, নাম না করে খোঁচা বিজেপি-কে
ঠাকুরপুকুরের একটি ক্যানসার হাসপাতালের অধিকর্তা অর্ণব গুপ্ত বলেন, ‘‘জীবনদায়ী অস্ত্রোপচার ছাড়া এই মুহূর্তে ক্যানসারের চিকিৎসা না-করাই ভাল। কারণ, কী ভাবে কোভিড ১৯ সংক্রমণ হবে, তা তো বোঝা যাচ্ছে না। সকলেরই তো করোনা-পরীক্ষা সম্ভব নয়। তবু জরুরি ক্ষেত্রে স্ক্রিনিং করে, রোগীর ট্রাভেল হিস্ট্রি খতিয়ে দেখে যতটা সম্ভব সুরক্ষিত অবস্থায় কাজ করা হচ্ছে।’’
কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। অনেক রোগীকে হাসপাতাল থেকে চিকিৎসার মাঝপথে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার রোগী লকডাউনের কারণে হাসপাতালে পৌঁছতেই পারছেন না! ক্যানসার রোগীদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় এই পরিস্থিতিতে হাসপাতাল কতটা নিরাপদ, তা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে একাধিক হাসপাতাল বা হাসপাতালের বিভাগ যেখানে করোনা-সংক্রমণের কারণে বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে ক্যানসারের ওষুধ পাওয়া নিয়েও। বিশেষ করে যাঁরা জেলায় থাকেন। লকডাউন পরিবহণ ব্যবস্থায় প্রভাব ফেলায় ওষুধ সরবরাহের ‘চেন’- ভেঙেছে। শহরে ক্যানসারের ওষুধ থাকলেও তা নিতে আসতে পারছেন না রোগীর পরিবারের সদস্যরা। ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘শহরে ক্যানসারের ওষুধের বড়সড় আকাল এখনই তৈরি না-হলেও যাঁরা শহরের বাইরে থাকেন, তাঁদের ভোগান্তি বাড়ছে। কেউ হয়তো ফোন করে এলাকার ওষুধের দোকানে বলছেন, এই ওষুধটা লাগবে। কিন্তু দোকানের পরিকাঠামো না-থাকায় ওষুধটা শহর থেকে আনানো যাচ্ছে না। এমনিতে অনেক জেলাতেই ক্যানসারের ওষুধ পাওয়া সমস্যার। এখন তা আরও বেড়ে গিয়েছে।’'
হাসপাতালগুলিতে কর্মী-চিকিৎসক সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে সংক্রমণের আশঙ্কা কমাতে। সুবীরবাবু জানান, কর্মীরা আসতে পারছেন না বলে ডাক্তারদের প্রাইভেট চেম্বার পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ক্যানসার রোগীদের নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করা সমাজকর্মী অনুপ মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘সরকারি হাসপাতালের সাধারণ দিনেই ক্যানসার বিভাগের আউটডোরে হাজার-হাজার রোগীর ভিড় হয়। এখন সেখানে হাতে-গোনা রোগীরা পৌঁছচ্ছেন। কোভিড -১৯ রাজ্যের ক্যানসার চিকিৎসাকে কমপক্ষে দু’বছর পিছিয়ে দিয়েছে!’’
অনেক ক্যানসার রোগীর পরিবারের আর্থিক অবস্থা এমনই যে, চিকিৎসার জন্য শুধু শহরে আসার খরচ জোগাড় করতেই রোজগারের বড় অংশ ব্যয় হয়। সেখানে লকডাউনের কারণে জীবিকার অনিশ্চয়তা, রোগের খরচ, সব মিলিয়ে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যার রেশ সুদূরপ্রসারী বলে আশঙ্কা চিকিৎসকদের। সরকারি হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ‘‘পরবর্তী কালে কোনও ক্যানসার রোগীর পরিবার হয়তো বলবে, ‘সরকারি হাসপাতালে পৌঁছতে পারলে নিখরচায় চিকিৎসা পাওয়া যেত ঠিকই। কিন্তু সেই পর্যন্ত পৌঁছতে পারলাম কই? তার আগেই তো সব শেষ হয়ে গেল!’ সেটা যেন না-হয়, এই মুহূর্তে সেটাই প্রার্থনা।’’
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)