প্রতীকী ছবি।
‘‘আমরা চলে গেলে ওকে দেখবে কে? কার কাছে রেখে যাব?’’ সন্তানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন বাবা-মা। ঘরের কোণে তখন নিবিষ্ট চিত্তে একটা গোল চাকতি ঘুরিয়েই চলেছে পাঁচ বছরের ডোডো।
শুধু ডোডোর বাবা-মা নন। একই প্রশ্ন তাড়া করে বেড়ায় আরও অনেক অটিস্টিক সন্তানের বাবা-মাকে। কারণ, তাঁরা ছাড়া ওই বাচ্চার মনের কথা বা অন্য চাহিদা বুঝবে কে? যে কারণে এখনও ২৩ বছরের অটিস্টিক ছেলেকে সর্বক্ষণ আগলে থাকেন সুরেশ সোমানি। তাঁর অবর্তমানে এই আগলে রাখার কাজটা কে করবে, সেই উদ্বেগ থেকেই ‘ইন্ডিয়া অটিজ়ম সেন্টার’ তৈরির পরিকল্পনা করেছেন ব্যবসায়ী সুরেশ। দক্ষিণ ২৪ পরগনার শিরাকোলে প্রায় ৫৩ একর জমিতে এই প্রকল্পের প্রাথমিক রূপরেখা তৈরি। শুধু মাত্র অটিস্টিকদের সমস্যা ও সমাধানের পথ খুঁজতেই এই প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে বলে তাঁর দাবি।
সুরেশ বলেন, ‘‘৬০০ জন অটিস্টিক ছেলে-মেয়ের চিকিৎসা, ছবি আঁকা, গান-বাজনা, কাঠের কাজের প্রশিক্ষণ, খেলাধুলোর ব্যবস্থা থাকবে। ওদের ২৪ ঘণ্টা দেখার জন্য ১৮০০ প্রশিক্ষিত কর্মী থাকবেন। কর্মীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, অটিজ়ম সংক্রান্ত গবেষণা কেন্দ্র ও হাসপাতাল থাকবে একই চৌহদ্দিতে।’’
আরও পড়ুন: কন্যাশ্রীর ভরসায় রুখেছিলেন বিয়ে, এখন আতান্তরে পুরুলিয়ার অষ্টমী
৬০০ আসনের এই কেন্দ্রে অর্থের বিনিময়ে ৩৫০ আবাসিকের ব্যবস্থা থাকবে। বাকি ২৫০ জন ‘ডে বোর্ডার’ হিসেবে সুযোগ-সুবিধা পাবে। অর্থাৎ তারা এখানে চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণের জন্য আসবে। গবেষণা কেন্দ্র ও হাসপাতাল তৈরির জন্য ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু হয়েছে বলে দাবি সুরেশের। আগামী মাসে কলকাতায় অটিজ়ম নিয়ে তিন দিনের একটি আলোচনাসভার আয়োজন করা হচ্ছে ‘ইন্ডিয়া অটিজ়ম সেন্টার’এর তরফে। দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি থাকবেন অটিস্টিক বাচ্চাদের বাবা-মা, সমাজকর্মী।
কিন্তু যাঁরা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন সন্তানদের ছেড়ে এক মুহূর্তও স্বস্তিতে থাকেন না, সেই বাবা-মায়েদের জায়গা হবে কি এই প্রকল্পে? সুরেশ জানান, আদতে এই প্রকল্পটিকে তিনি অটিজ়ম উপনগরী হিসেবে তৈরি করতে চাইছেন। সন্তানদের কাছাকাছি থাকার জন্য তৈরি হবে কয়েকটি বাড়ি। তবে তা কেনা যাবে না। টাকার বিনিময়ে থাকা যাবে। যত দিন তাঁদের সন্তান এখানে থাকবে, তত দিন তাঁরাও থাকতে পারবেন।
‘অটিজ়ম সোসাইটি অব ওয়েস্ট বেঙ্গল’-এর প্রতিষ্ঠাতা ইন্দ্রাণী বসু বলেন, ‘‘আমাকে ভাবতে হবে আমার অবর্তমানে কী ভাবে বাঁচবে সন্তান। এর জন্য প্রথমেই প্রয়োজন নিজেদের মধ্যে সাপোর্ট নেটওয়ার্ক তৈরি করা। এর পরে সরকারের থেকে বুঝে নিতে হবে নিজেদের অধিকারের কথা। সেই অধিকার রক্ষার লড়াইটাও লড়তে হবে বাবা-মাকেই।’’ এ প্রসঙ্গে উঠে এসেছে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে পাশ হওয়া প্রতিবন্ধী অধিকার আইনের কথা। যে আইনের আওতায় রয়েছে অটিজ়মও। কিন্তু এখনও তা নিয়ে সচেতনতা নেহাতই কম বলে জানান ইন্দ্রাণী।
শিশুরোগ চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ বলেন, ‘‘সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে বলেই অটিস্টিক সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন বাবা-মায়েরা। এ ধরনের প্রকল্প সেই চিন্তা কিছুটা দূর করতে পারে। পরিকাঠামোগত সুবিধা ও পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের দেশ এখনও পিছিয়ে রয়েছে। সেই ঘাটতিও কিছুটা পূরণ করতে পারে এ ধরনের প্রকল্প।’’
বেসরকারি এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে অটিজ়ম নিয়ে কাজ করা সমাজকর্মী অমৃতা পাণ্ডা। ১৮০টি অটিস্টিক বাচ্চা তাঁর তৈরি সংস্থার ‘হোম’-এ থাকে। সেখানে ঠাঁই পেয়েছে আর্থিক ভাবে একেবারে পিছিয়ে থাকা পরিবারের বাচ্চাও। তাঁর মতে, সমাজের সব স্তরের মানুষের কাছে এই প্রকল্পের পরিষেবা পৌঁছতে পারলে, তবেই তা সফল হবে। পরিষেবা দেওয়ার খরচ বেঁধে ফেলার ক্ষেত্রে বিষয়টি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।