কয়েকটি পুরসভাকে পুর নিগমের সঙ্গে যুক্ত করার কাজ চলছে এই যুক্তি দেখিয়ে সেখানে একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বন্ধ রাখা অনুচিত বলে সোমবার মন্তব্য করল কলকাতা হাইকোর্ট।
রাজ্যের সাত পুরসভায় ভোট না-করার যে সরকারি সিদ্ধান্ত, তারই প্রেক্ষাপটে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুরের ডিভিশন বেঞ্চের এ হেন পর্যবেক্ষণ। সংশ্লিষ্ট পুরসভাগুলোয় নির্বাচন ঝুলিয়ে রেখে সংযুক্তিকরণের প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে কেন, সে সম্পর্কেও রাজ্য নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্য সরকারের ব্যাখ্যা চেয়েছে বেঞ্চ। তিন সপ্তাহের মধ্যে দু’পক্ষকে এ বিষয়ে ডিভিশন বেঞ্চে হলফনামা জমা দিতে বলা হয়েছে।
রাজ্য নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছে, আগামী ১৮ এপ্রিল কলকাতা পুরসভায় নির্বাচন হবে। আরও ৯১টি পুরসভায় ভোট হবে ২৫ এপ্রিল। কিন্তু আসানসোল, জামুড়িয়া, কুলটি, রানিগঞ্জ, বিধাননগর, রাজারহাট-গোপালপুর ও বালি এই সাতটি পুরবোর্ডের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সেগুলোয় নির্বাচনের দিন ঘোষণা হয়নি। রাজ্য সরকারের যুক্তি: ওখানে বিভিন্ন পুর-ওয়ার্ডের পুনর্বিন্যাস ও পুর নিগমে সংযুক্তির কাজ চলছে। তাই এই মুহূর্তে নির্বাচন করা যাচ্ছে না।
সাত পুরসভায় ভোট স্থগিত রাখার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই হাইকোর্টে জনস্বার্থ-মামলা দায়ের হয়েছে। গত শুক্রবার প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে তার শুনানির সময়ে আদালত প্রশ্ন তুলেছিল, মেয়াদ থাকতে থাকতে সংবিধান মেনে সাতটি পুরসভায় নতুন বোর্ড গড়া হল না কেন?
এ দিন আদালতে কার্যত একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। শুনানির শুরুতে প্রধান বিচারপতি জানতে চান, “ভোট করতে অসুবিধা কোথায়?” নির্বাচন কমিশনের কোঁসুলি নয়ন বিহানিকে আদালত জিজ্ঞাসা করে, “রাজ্যকে কেন আগে জানানো হয়নি, ওই সাত পুরসভায় বোর্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে?”
কমিশনের তরফে জবাব মেলেনি। এই অবস্থায় রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্রের উদ্দেশে কোর্টের মন্তব্য, “সংযুক্তিকরণের জন্য দিন ঘোষণা হচ্ছে না এটা খারাপ যুক্তি।”
বস্তুত বেঞ্চ এ দিন পরিষ্কার জানিয়েছে, সংযুক্তিকরণের দোহাই দিয়ে নির্বাচন বন্ধ রাখা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরিপন্থী। “ওখানে ভোটপর্ব শেষ করেও সংযুক্তির কাজ হতে পারত।” পর্যবেক্ষণ আদালতের। তারা মনে করে, এ ব্যাপারে ছ’মাস আগেই সরকার ও কমিশনের উদ্যোগী হওয়া উচিত ছিল।
পাশাপাশি রাজ্যের প্রস্তাব মতো পুরভোটের দিন ঘোষণা করার বৈধতা ঘিরেও প্রশ্ন উঠেছে। জনস্বার্থ-আবেদনটির বক্তব্য: রাজ্য সরকারের প্রস্তাব মেনে কমিশন ভোটের দিন ঘোষণা করলে তা অসাংবিধানিক। “সংবিধান অনুযায়ী, ভোটের দিন ঘোষণার সর্বোচ্চ এক্তিয়ার রাজ্য নির্বাচন কমিশনেরই হাতে।” এ দিন সওয়ালে দাবি করেছেন আবেদনকারীর কৌঁসুলি অনিন্দ্য মিত্র।
এরই প্রেক্ষিতে কলকাতা-সহ ৯২টি পুরভোটের বিজ্ঞপ্তি পড়ে গিয়েছে বিতর্কের মুখে। কারণ, রাজ্যের প্রস্তাব মেনেই কমিশন নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছে। অন্য দিকে রাজ্যের তরফে অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্তবাবুর যুক্তি: নির্বাচন প্রক্রিয়া যে হেতু শুরু হয়ে গিয়েছে, তাই এখন এ সব প্রশ্ন তুলে প্রক্রিয়া থমকে দেওয়া যায় না।
আজ মঙ্গলবার জয়ন্তবাবুকে এ প্রসঙ্গে নিজের যুক্তি বিস্তারিত ভাবে পেশ করতে বলেছে বেঞ্চ। এ-ও ইঙ্গিত দিয়েছে, ৯২টি পুরসভায় নির্বাচন আয়োজনের বিজ্ঞপ্তির বৈধতা সম্পর্কে আজ আদালতও নিজের মনোভাব ব্যক্ত করতে পারে। হাইকোর্ট মনে করছে, নির্বাচন সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত কমিশনেরই নেওয়া উচিত। তবে নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে রাজ্য সরকারের সঙ্গে তাদের আলোচনার পথ সব সময়ে খোলা থাকতে বাধা নেই। নির্বাচন কমিশনের কী বক্তব্য?
রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় মনে করেন না যে, কমিশন অসাংবিধানিক কিছু করেছে। এ দিন তিনি বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ পুর নির্বাচন আইনের (১৯৯৪) ৩৬ (৩) ধারা অনুযায়ী ৯২টি পুরসভায় ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে। ওই আইনের ৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, পুর নির্বাচনের দিন রাজ্য ঠিক করবে।” তবে জনস্বার্থ- মামলার প্রেক্ষাপটে মেয়াদ-উত্তীর্ণ সাত পুরসভায় ভোট আয়োজনের ব্যাপারে তিনি এখন কিছুটা আশার আলো দেখছেন। ওই সাতটি পুরসভায় ভোট করার জন্য কমিশনের তরফে রাজ্যকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। সরকারের অবস্থান কী?
পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, “রাজ্য সরকার তার বক্তব্য আদালতে জানাবে।” যদিও মন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট, সাত পুরসভায় এখনই নির্বাচন করায় সরকারের অনীহা যথেষ্ট। “ঘন ঘন ভোট হলে উন্নয়নের কাজ থেমে যায়। উপরন্তু পুরসভাগুলোয় আলাদা আলাদা নির্বাচন করার পরে নিগমে সংযুক্তি হলে ওয়ার্ডের সংখ্যায় হেরফের হবে। ফলে ছ’মাস বাদে ফের ভোট করতে হবে।” যুক্তি দিচ্ছেন ফিরহাদ। তাঁর কথায়, “এ সব ঝক্কি এড়াতেই সংযুক্তিকরণ সেরে ভোট করার কথা ভাবা হয়েছে। সরকার চায় না, জনগণের করের টাকায় ঘনঘন ভোট হোক।”
পুরভোট-বিতর্কের প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনের দিকে তোপ দাগছে বিরোধীরা। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু এ দিন অভিযোগ করেন, জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণে বিরত রাখার চেষ্টা চলছে। “কমিশন গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি মেনে কাজ করছে না।” বলেন বিমানবাবু। কমিশন রাজ্যের অঙ্গুলিহেলনে চলছে বলে অভিযোগ তুলে বিজেপি-র তথাগত রায়ের মন্তব্য, “রাজ্যবাসীর দুর্ভাগ্য, স্বাভাবিক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রক্রিয়াগুলি নিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশের অপেক্ষা করতে হচ্ছে। বর্তমান প্রশাসন রাজনৈতিক স্বার্থ নিয়ে চলছে।”