ও-পারে বাংলাদেশের যশোরের পুঁটখালি। এ-পারে উত্তর ২৪ পরগনার আংরাইল। মাঝখানে বয়ে চলেছে ইছামতী। দুই বাংলার এই সীমান্ত এলাকা দিনের বেলায় যেন শান্তির নীড়। অথচ অন্ধকার ঘনালেই বদলে যায় আংরাইল। শান্ত ইছামতীতে নামিয়ে দেওয়া হয় গরুর পাল। কোনও রাতে শয়ে শয়ে, কোনও রাতে বা হাজার হাজার।
আংরাইল জানে, দুই পারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীও জানে, পাচার হওয়া এই গরুর পালের ‘অভিভাবক’-এর নাম সমীর মজুমদার। পাচার-সিন্ডিকেটের মধ্যমণি তিনি। বাংলাদেশের গুলশনে জঙ্গি হানার পর সীমান্তে যে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে, তার অঙ্গ হিসেবে শনিবার পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করেছে।
পুলিশ জানিয়েছে, বছর দশেক গরু পাচারে যুক্ত মধ্য পঞ্চাশের সমীর। আগে সে বনগাঁর ছয়ঘরিয়া দিয়ে গরু পাচার করত। এখন আংরাইলকে কেন্দ্র করে বসিরহাটের বর্ণবাড়িয়া পর্যন্ত চলে তাঁর কারবার। এই কাজে তাঁর নেতৃত্বে যে ছয় চাঁই রয়েছে— পুলিশ, বিএসএফ থেকে এলাকার সবাই তাঁদের চেনেন-জানেন বলে অভিযোগ।
এলাকায় কান পাতলেই শোনা যায় সমীরের পাচার-কারবারের সাতকাহন। কী রকম? ব্যবসার খাতিরে আংরাইলের বাসিন্দা দুই ভাইকে ‘ধর্ম-শ্বশুর’ পাতিয়েছেন সমীর। আর নিজের বোনের বিয়ে দিয়েছেন বাহিনীর এক জনের সঙ্গে। সেই বোন আবার স্থানীয় একটি পঞ্চায়েতে তৃণমূলের প্রধান। এলাকাবাসীর অভিযোগ, পাচারকারীদের ধরতে পুলিশ বা বিএসএফ যত বারই অভিযান চালিয়েছে, আগে খবর পেয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে তারা।
সমীরের উত্থান বেশ চমকপ্রদ। গরু-সিণ্ডিকেটে তিনিই একমাত্র মাধ্যমিক পাশ। ব্যবহারও মধুর। পুলিশ, বিএসএফ বা শুল্ক দফতরকে ‘ম্যানেজ’ করে টাকা দেওয়া থেকে ব্যবসার যাবতীয় ঝক্কি সমীরই সামলাতেন।
কী ভাবে বিএসএফ এবং পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করতেন সমীর?
ধরা যাক, ২০০টি গরু ধরেছে বিএসএফ। এর মধ্যে ১০০টি গরু দেওয়া হল শুল্ক দফতরকে নিলাম করার জন্য। দেখা যেত, শুল্ক দফতরের কাছ থেকে সমীররাই সব সময়ে নিলামের গরু কিনছে। আবার বাকি ১০০টি গরুও বিএসএফ-কে টাকা দিয়ে নিয়ে নিত সমীরের দল। চেনা পথে সেই গরু ফের পাচার হয়ে যেত বাংলাদেশে।
আংরাইল থেকে বর্ণবাড়িয়া— সর্বত্র হাট থেকে গরু কেনার সময়ে শাসক দলের স্থানীয় সিন্ডিকেটকে টাকা দিতে হত। চুক্তি অনুযায়ী টাকা দিতে হত পুলিশ ও বিএসএফ-কে। সূত্রের খবর— শাসক দলের বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধি, পুরসভার চেয়ারম্যান, এমনকী বিধায়কদের কাছেও নিয়মিত গরু পাচারের টাকা চলে যেত। এলাকায় শাসক দলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের খরচ, মঞ্চ বানিয়ে দেওয়া, সাউন্ড-সিস্টেমের টাকা দেওয়া, ব্যানার-ফ্লেক্স তৈরি করে দেওয়ায় জন্যও ডাক পড়ত সমীরদের।
প্রশাসনের খবর, গত বিধানসভা ভোটেও শাসক দলের তহবিলে বিপুল টাকা ঢালতে হয়েছে সমীরদের। তার পরেও কেন এই গ্রেফতার, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে আংরাইল।