জল্পনা পাখা মেলছে প্রায় প্রতি দিনই! কখনও পাখার ঝাপ্টা বেশ জোরে, কখনও একটু স্তিমিত। তার হাওয়ায় ভেসে না গেলেও আঁচ়়ড় পড়ছে বিশ্বাসযোগ্যতায়। এ বার তাই জল্পনার জবাব দিতে প্রয়াত নেতার স্মরণ সভাকেই বেছে নেওয়ার আয়োজন উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সিপিএমে! বাম জমানার ডাকসাইটে মন্ত্রী এবং সিপিএম নেতা সুভাষ চক্রবর্তীর ষষ্ঠ প্রয়াণ দিবস আগামী ৩ অগস্ট। ওই দিনটিতে প্রতি বছরই ‘সুভাষ স্মরণে’র আয়োজন করে থাকেন প্রয়াত নেতার অনুগামীরা। কিন্তু এ বারের উদ্যোগ একটু অন্য রকম। সুভাষের মৃত্যু দিনে এ বারের স্মারক আলোচনার বিষয়: ‘সুবিধাবাদী দলবদল গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে’! সচরাচর স্মরণ সভায় যে ধরনের বিষয় বেছে নেওয়া হয়, সে সব ছাপিয়ে এ বারের উদ্যোগের পিছনে নির্দিষ্ট বার্তা দেওয়ার চেষ্টা স্পষ্ট!
আয়োজক সরাসরি সিপিএম নয়। আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্যোক্তাদের পরিচয় ‘সুভাষ চক্রবর্তী ফাউন্ডেশন’ এবং আরও একটি বেসরকারি সংস্থা। যার মাথায় আছেন সুভাষ-জায়া এবং উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের নেত্রী রমলা চক্রবর্তী। সুভাষ স্মরণের উপলক্ষে জল্পনার জবাব দেওয়ার চেষ্টা মূলত তাঁরই উদ্যোগে। কারণ, স্বয়ং রমলা থেকে শুরু করে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের এক প্রাক্তন বিধায়ক, জেলার এক প্রাক্তন সাংসদের স্ত্রী-সহ জেলার একগুচ্ছ সিপিএম নেতা-নেত্রী দল বদলে তৃণমূলে চলে যাচ্ছেন বলে রটনা হচ্ছে বিস্তর! সরাসরি দলের মঞ্চ থেকে এ সবের জবাব দেওয়া একটু অসুবিধাজনক। আবার কিছু না বললেও মৌনকে সম্মতির লক্ষণ ধরে নিলেও বিপদ! তাই স্বামীর স্মরণের মঞ্চকেই বেছে নিয়েছেন সুভাষ-জায়া। এবং জল্পনার কেন্দ্রে থাকা নেতা-নেত্রীরা সেই মঞ্চে কেউই নিজেরা বলবেন না। প্রধান বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম। তাতে অনুষ্ঠান অরাজনৈতিক থাকল, আবার বার্তার মধ্যে সিপিএমের স্পষ্ট ছাপও পড়ে ফেলা গেল!
আরও তাৎপর্যপূর্ণ হল, দলবদল নিয়ে নানাবিধ জল্পনার সূত্রপাত রাজারহাটের প্রাক্তন চেয়ারম্যান তাপস চট্টোপাধ্যায় সিপিএম ছেড়ে সম্প্রতি তৃণমূলে যাওয়ার পর থেকেই। এক কালে যে তাপসের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল সুভাষ অনুগামীদের বৃত্তে! অতীতে সুভাষ স্মরণ অনুষ্ঠানেও তাঁর কায়দায় মাথায় পানামা হ্যাট চাপাতে দেখা গিয়েছে তাপসবাবুকে। তিনি সিপিএম ছা়ড়ার পরে প্রথম সুভাষ স্মরণের অনুষ্ঠানেই তাঁর ভোলবদলের ঘটনাকে বিঁধতে চাইছেন অন্য অনুগামীরা! তা-ও বিধাননগর ও রাজারহাটে পুরভোটের মুখে!
রমলাদেবীর কথায়, ‘‘আমি কয়েকটা দিন বাইরে ছিলাম। তখন শুনলাম, চার দিকে প্রচার হয়ে গিয়েছে ২১ জুলাই আমি নাকি তৃণমূলে যোগ দিচ্ছি! এ সব ঘটেছে বলেই ওঁর (সুভাষ) চলে যাওয়ার দিনটায় এ বার প্রাসঙ্গিক কিছু ভাবনাচিন্তা করেছি।’’ সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য সেলিমও বলছেন, ‘‘এখনকার সময়ের জন্য বিষয়টার তাৎপর্য আছে। সংসদের অধিবেশনের মধ্যেও আমি ওখানে যাওয়ার চেষ্টা করব।’’
প্রতি বছরের মতোই এ বারও সুভাষ স্মরণের সভাপতিত্বের দায়িত্ব লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের উপরে। প্রয়াত জ্যোতি বসুর শিষ্য হিসেবে সুভাষের সঙ্গে সোমনাথবাবুর হৃদ্যতাও ছিল সুবিদিত। বক্তা হিসেবে ডাকা হয়েছে কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষকেও। তৃণমূল ছে়ড়ে কংগ্রেসে ফেরার সময় যিনি বিধায়ক পদ ছেড়ে এসেছিলেন। বিধাননগরের পূর্বাঞ্চলীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে এ ছা়ড়়াও বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় এবং দুই অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার ও বাদশা মৈত্র।
সিপিএমের একাংশে ক্ষোভ, দল বদলের রটনার পিছনে দলের একাংশেরও হাত আছে। দলের সেই অংশকে বার্তা দিতেও এই অনুষ্ঠানের আয়োজন বলে সিপিএমের একাংশের ব্যাখ্যা। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের এক নেতার কথায়, ‘‘দল ক্ষমতায় থাকতেই সুভাষদা বিদায় নিয়েছেন। এই অসুস্থ রাজনীতির সময়ে সুভাষদা থাকলে সিপিএমের পতাকা নিয়েই বুক চিতিয়ে লড়তেন!’’ এরই মধ্যে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র মন্তব্য করেছিলেন, যাঁরা দলের উপরে ক্ষুব্ধ, তাঁদের সঙ্গে একশো বার আলোচনায় তিনি রাজি। কিন্তু কোনও অছিলায় যাঁরা অন্য দলের দিকে পা বাড়িয়ে আছেন, তাঁরা গেলেই ভাল। যার প্রেক্ষিতে আবার ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা উদয়ন গুহ নাম না করে সোশ্যাল সাইটে মন্তব্য করেছেন, ‘‘লোম বাছতে গিয়ে কম্বল না শেষ হয়ে যায়!’’
এই বাতাবরণেই বার্তা দেওয়ার আয়োজন সুভাষ অনুগামীদের!