সম্পাদক পদে বিমানকে রাখা নিয়ে ভিন্নমত বুদ্ধ-গৌতম

তাঁর নেতৃত্বে বিপর্যস্ত দল। তবু সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক পদে বিমান বসুকে আরও এক বার রেখে দেওয়া নিয়ে দলের মধ্যে একটি প্রভাবশালী পক্ষ সরব হয়েছে। আর এক পক্ষ বদল চান নেতৃত্বে। এ নিয়ে মতভেদ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে বিষয়টি দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট পর্যন্ত গড়িয়েছে। আগামী মার্চে দলের রাজ্য সম্মেলনে পরবর্তী রাজ্য সম্পাদক ঠিক হওয়ার কথা।

Advertisement

প্রসূন আচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:২০
Share:

শুক্রবার ‘সম্প্রীতি সমাবেশ’ মঞ্চে বিমান বসু। ছবি: প্রদীপ আদক

তাঁর নেতৃত্বে বিপর্যস্ত দল। তবু সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক পদে বিমান বসুকে আরও এক বার রেখে দেওয়া নিয়ে দলের মধ্যে একটি প্রভাবশালী পক্ষ সরব হয়েছে। আর এক পক্ষ বদল চান নেতৃত্বে। এ নিয়ে মতভেদ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে বিষয়টি দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট পর্যন্ত গড়িয়েছে।

Advertisement

আগামী মার্চে দলের রাজ্য সম্মেলনে পরবর্তী রাজ্য সম্পাদক ঠিক হওয়ার কথা। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য চান, বিমানবাবুর পরিবর্তে এ বার রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নিন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মদন ঘোষের নেতৃত্বাধীন বর্ধমান এবং উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ জেলা, নদিয়ার মৃদুল দে, মুর্শিদাবাদের নৃপেন চৌধুরীও বুদ্ধবাবুর মতেরই সমর্থক। অন্য দিকে, বিমানবাবুকেই আরও এক বার রাজ্য সম্পাদক রেখে আগামী বিধানসভা ভোটে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে সূর্যবাবুকে তুলে ধরার পক্ষপাতী গৌতম দেবের নেতৃত্বে দুই ২৪ পরগনা জেলা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুজন চক্রবর্তী, পশ্চিম মেদিনীপুরের দীপক সরকার, বাঁকুড়ার অমিয় পাত্রও এই মতের পক্ষে।

বিমানবাবু নিজে কিন্তু আরও এক বার সম্পাদক পদে থাকতে আগ্রহী। ২০০৬ সালে বিধানসভা ভোটের আগে অনিল বিশ্বাসের আকস্মিক মৃত্যুতে মাঝপথে বিমানবাবু রাজ্য সম্পাদক হন। তিন বারের বেশি কেউ সম্পাদক পদে থাকতে পারবেন না এই নিয়ম বিমানবাবুর ক্ষেত্রে কার্যকর নয়। কারণ, তিনি তিন বার পুরো মেয়াদের রাজ্য সম্পাদক নন। শারীরিক ভাবে এখনও যথেষ্ট সক্ষম বলে তিনি দেখাতে চান।

Advertisement

সম্প্রতি হায়দরাবাদে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের পরে কারাট জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি আর সাধারণ সম্পাদক থাকবেন না। বিমানবাবু অবশ্য এখনও নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। দলীয় সূত্রে খবর, সূর্যবাবু রাজ্য সম্পাদক হলেও বিমানবাবুকেই বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান রেখে দেওয়ার সূত্র ধরেই এগোচ্ছেন বুদ্ধবাবু। যে ভাবে অনিল বিশ্বাস দলের রাজ্য সম্পাদক হলেও শৈলেন দাশগুপ্ত ছিলেন ফ্রন্ট চেয়ারম্যান। পরে বিমানবাবু চেয়ারম্যান হন।

গত ছ’ মাস ধরে নানা কারণে বিমানবাবু ও বুদ্ধবাবুর সম্পর্ক আর আগের মতো ঠিক নেই। বিমানবাবু যে ভাবে ফ্রন্টের বাইরে থাকা এসইউসি, পিডিএস, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-সহ নকশালপন্থীদের ‘গুরুত্ব’ দিচ্ছেন, তাতে বুদ্ধবাবু ক্ষুণ্ণ। তিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যাপারে এসইউসি, নকশালপন্থীরা বুদ্ধবাবুর কড়া সমালোচনা করেছিল। তৃণমূলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আন্দোলনও করেছিল।

সম্প্রতি আরও একটি বিষয়ে দুই নেতার মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। বুদ্ধবাবু মনে করেন, রাজ্যে সিপিএমের সব চেয়ে বড় প্রতিপক্ষ তৃণমূল। যে কারণে, সংসদে তৃণমূলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানোয় আপত্তি তুলে মধ্যরাতে বিবৃতি জারি করেছিলেন বুদ্ধবাবু। কিন্তু বিমানবাবুর মতে— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নয়, সিপিএমের প্রধান প্রতিপক্ষ এখন বিজেপি। নবান্নে ফিশ ফ্রাই খেয়ে হাসিমুখে মমতার হাতে স্মারকলিপি তুলে দেওয়াকে বিমানবাবু গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অংশ হিসাবেই মনে করেন।

দলে বিমান-বুদ্ধ দু’জনেরই ঘনিষ্ঠ গৌতম দেব। অসুস্থ অবস্থাতেও তাঁর পরিকল্পনায় গত ডিসেম্বরে শহিদ মিনার ময়দানের সভায় ভাল ভিড় হয়েছিল। দলের ছাত্র-যুবরা ‘নবান্ন অভিযান’ কর্মসূচিতে পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভও দেখায়। এর পর থেকেই বিভিন্ন জেলা সম্মেলনে গৌতমবাবুর সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন বিমানবাবু। আরও এক বার বিমানবাবুকে সম্পাদক রেখে দেওয়ার জন্য সম্প্রতি কারাটের কাছে আর্জি জানিয়েছেন গৌতমবাবু। দলীয় সূত্রে খবর— কারাটকে তিনি বলেছেন, রাজ্যে তৃণমূলের জনপ্রিয়তা দ্রুত কমছে। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে মুখ্যমন্ত্রী পদে সূর্যবাবুকে তুলে ধরে এখন থেকেই প্রচারে নামা উচিত। তাঁর এই প্রস্তাব কারাটরা মানলে বিমানবাবু যেমন খুশি হবেন, ভবিষ্যতে রাজ্য সম্পাদক হওয়ার জন্য গৌতমবাবুর রাস্তাও খোলা থাকবে।

দলীয় রাজনীতিতে গৌতমবাবু ‘বুদ্ধ-ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে পরিচিত। অথচ তাঁর মতের বিরুদ্ধে কেন গৌতমবাবু গেলেন, তা জানতে চেয়ে বুদ্ধবাবুকে ফোন করেছিলেন কারাট। দলীয় সূত্রের খবর, কারাটের ফোন পেয়ে গৌতমবাবুর উপরে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হয়েছেন বুদ্ধবাবু। গৌতমের ঘনিষ্ঠ এক নেতাকে বুদ্ধবাবু বলেছেন, সূর্যকে রাজ্য সম্পাদক করার প্রক্রিয়া অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও কারাটের কাছে এমন কথা বলে আসলে কী বার্তা দিতে চাইছেন গৌতম? সম্প্রতি দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। গৌতমবাবুর এই ‘ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা’র কড়া সমালোচনা করেন মদন-নৃপেনরা। বৈঠকে উপস্থিত থাকলেও বুদ্ধবাবু কিছু বলেননি। তবে চাপে থাকলেও আশা ছাড়ছেন না বিমানপন্থীরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন