পদার্থবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা। আর একই সঙ্গে চিত্রকলার সর্বোচ্চ পাঠ নিয়ে ভ্যান গঘের মাস্টারপিস ‘দ্য স্টারি নাইট’-এর রহস্যভেদ। টালিগঞ্জের শতদ্রু সিংহের এই স্বপ্ন এ বার সম্ভবত সফল হতে চলেছে।
শতদ্রুর স্বপ্ন সাকার করতে সহায়ক হতে চলেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। পঠনপাঠনের বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে এত দিনে পড়ুয়াদের পছন্দকেই অগ্রাধিকার দিতে চলেছে তারা। সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) স্বাগত সেন জানান, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে স্নাতকোত্তর বিভাগে ‘চয়েস বেসড ক্রেডিট সিস্টেম’-এ পঠনপাঠন শুরু করে দিতে ইচ্ছুক কলকাতা। এই বিষয়ে বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, হচ্ছে। কী ভাবে ওই বিশেষ পদ্ধতি রূপায়ণ করা যায়, সেই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করতে প্রধানদের সবিস্তার মতামতও চেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষ।
পঠনপাঠনের গতানুগতিক ধরন যে পাল্টাতে হবে, কয়েক সপ্তাহ আগে কলকাতায় এসে সেই ব্যাপারে এক রকম নির্দেশই দিয়ে গিয়েছেন ইউজিসি বা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান বেদপ্রকাশ। শুধু নির্দেশ নয়, পরিবর্তনের পথও বাতলেছেন তিনি। ‘চয়েস বেসড ক্রেডিট সিস্টেম’-ই সেই পথ। তাঁর নির্দেশিত রাস্তায় হেঁটে পঠনপাঠনে এ বার পড়ুয়াদের পছন্দকেই অগ্রাধিকার দিতে চলেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। তবে সেই উদ্যোগ একেবারে বিতর্কহীন থাকছে না। এক শিবিরের বক্তব্য, এই পদ্ধতি মাননীয়। কারণ, এতে পড়ুয়া বিষয় বাছাইয়ের স্বাধীনতা ভোগের সূত্রে মানসমুক্তির অবকাশ পাবেন। আবার শিক্ষারই অন্য শিবির বলছে, এই প্রণালীতে বৈচিত্রের বাহারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ুয়ার একমুখিতা ব্যাহত হতে পারে। শিক্ষা না-ও পেতে পারে বাঞ্ছিত গভীরতা। শিক্ষাচিন্তকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই চালু হচ্ছে নতুন ব্যবস্থা।
‘চয়েস বেসড ক্রেডিট’ কী?
এই ব্যবস্থায় যে-কোনও শাখার যে-কোনও পড়ুয়ার পছন্দমতো বিষয় বেছে নেওয়ার অধিকার থাকবে। অর্থাৎ ভূগোল বা অঙ্ক পড়তে পড়তে যদি কোনও পড়ুয়ার মনে হয়, তিনি একই সঙ্গে রসায়ন বা চিত্রকলা নিয়ে পড়বেন, সেই বিষয় বেছে নেওয়ার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে তাঁর। শুধু তা-ই নয়, যদি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রিয় বিষয়টি পড়ানো না-হয়, একই সঙ্গে তিনি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে তা পড়তে পারবেন।
আর মূল্যায়ন?
‘‘ইউজিসি-র নিয়ম বলছে, মূল বিষয়ের উপরেই পড়ুয়ার মূল্যায়ন হবে। কেউ যদি চায় মূল বিষয় বাণিজ্যের সঙ্গে ইতিহাসও পড়বে, সেই ক্লাসটা তাকে ইতিহাস বিভাগে গিয়ে করতে হবে,’’ বললেন স্বাগতবাবু।
ফেব্রুয়ারিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে এসে ইউজিসি-প্রধান বেদপ্রকাশ বলেছিলেন, চলতি বছরেই রাজ্যের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই নতুন পদ্ধতি চালু করতে হবে। এবং পছন্দসই বিষয়ের মিশ্র পাঠ চালু করতে হবে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর দুই স্তরেই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্য আপাতত শুধু স্নাতকোত্তরের পড়ুয়াদের জন্যই এই নতুন নিয়মের কথা ভাবছে। উপাচার্য সুগত মারজিত বলেন, ‘‘আমাদের পক্ষে স্নাতক স্তরে এখনই এই চয়েস বেসড পড়াশোনা শুরু করা সম্ভব নয়। স্নাতকোত্তরে এটা যত দ্রুত চালু করা যায়, সেই চেষ্টাই চলছে। এপ্রিল থেকেই কাজ শুরুর কথা ভাবছি আমরা।’’
রাজ্যের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সময়োপযোগী অনেক বিষয় পড়ানো হয় না। দেশেরই অন্যান্য শিক্ষা কেন্দ্রের পাঠ-পদ্ধতি এবং পাঠ্যক্রম যতটা বাস্তবসম্মত, সেই তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে আছে অনেক— এমনটাই মত শিক্ষামহলের। এই অবস্থায় পছন্দসই পড়াশোনার এই পদ্ধতি কতটা ফলপ্রসূ হবে?
এ রাজ্যে এখন শুধু প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়েই চয়েস বেসড ক্রেডিট পদ্ধতি চালু আছে। সেখানকার প্রাক্তন উপাচার্য মালবিকা সরকার বর্তমানে রয়েছেন দিল্লির অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে এই চয়েস বেসড পদ্ধতি প্রচলিত। মালবিকাদেবী বলেন, ‘‘আমাদের এখানে প্রথমেই অনার্স বিষয় নিতে বলা হয় না। প্রথম দুই সেমেস্টারে পড়ুয়া নিজের পছন্দের নানান বিষয় পড়ে। তার পরে তার যেটা পছন্দ, সেই বিষয়েই সে সবিস্তার পড়াশোনা করতে পারে।’’
মালবিকাদেবীর বক্তব্য, এখন পড়াশোনা অনেক ব্যাপ্ত। এই পদ্ধতিতে সেই ব্যাপ্তিকে ছোঁয়া যায়। অনেক প্রশস্ত হয় গবেষণার ক্ষেত্রও। ধীরে ধীরে এই ব্যবস্থাই গৃহীত হচ্ছে সারা দেশে। সুতরাং যত দ্রুত সম্ভব রাজ্যে এই নিয়মে পঠনপাঠন শুরু করা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেন তিনি।
ইচ্ছেমতো বিষয় বাছাইয়ের ব্যবস্থাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ও। তাঁর বিশ্বাস, এই নিয়ম পড়াশোনাকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাবে।
বিষয়টিকে ‘শৌখিন অভিনবত্ব’ বলেই মনে করছেন প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, এটি সম্পূর্ণ ভুল পদ্ধতি। ‘‘যদি কেউ রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা করে, সেই বিষয়কেন্দ্রিক অন্য বিষয় বেছে নেওয়াটাই ঠিক পদ্ধতি। একমাত্র তা হলেই তার গভীরতা বাড়বে,’’ মন্তব্য অমলবাবুর।
তবে পড়ুয়ার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে কর্মসংস্থান কতটা সফল হবে, প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। তিনি বলেন, ‘‘বিদেশে বিষয়টাকে ‘ক্যাফেটেরিয়া সিস্টেম’ বলা হয়। ইচ্ছেমতো বিষয় বাছার সুবিধা আছে সেখানে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও মানুষ চাকরি খুঁজতেই পড়াশোনা করে।’’ যে-শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রায় সকলে ‘স্পেশ্যালাইজড’ হতেই স্বচ্ছন্দ, সেখানে এমন প্রয়োগমূলক ব্যবস্থা কতটা কার্যকর হয়, সেটাই দেখার, বলছেন পবিত্রবাবু।