মাওবাদী মন্ত্রণায় নিজের পায়ে কুড়ুল ছত্রধরের

সাতসকালে লালগড়ের দলিলপুর চকে দাঁড়িয়ে মোবাইল কানে আর্তি ছত্রধর মাহাতোর, ‘‘দিদি, দয়া করে আমাদের পাশে দাঁড়ান। পুলিশের অত্যাচার ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে।’’ তারিখটা ২০০৮ সালের ৬ নভেম্বর। আগের রাতেই ছোটপেলিয়া গ্রামে পুলিশের তল্লাশি অভিযানে বাঁ চোখ থেঁতলে গিয়েছে ছিতামুনি মুর্মুর। জখম হয়েছেন আরও কয়েক জন মহিলা।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৫ ০৪:১২
Share:

২০০৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। লালগড়ের খাসজঙ্গলের সভায় পাশাপাশি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ছত্রধর মাহাতো। — ফাইল চিত্র।

সাতসকালে লালগড়ের দলিলপুর চকে দাঁড়িয়ে মোবাইল কানে আর্তি ছত্রধর মাহাতোর, ‘‘দিদি, দয়া করে আমাদের পাশে দাঁড়ান। পুলিশের অত্যাচার ভয়ঙ্কর আকার নিয়েছে।’’

Advertisement

তারিখটা ২০০৮ সালের ৬ নভেম্বর। আগের রাতেই ছোটপেলিয়া গ্রামে পুলিশের তল্লাশি অভিযানে বাঁ চোখ থেঁতলে গিয়েছে ছিতামুনি মুর্মুর। জখম হয়েছেন আরও কয়েক জন মহিলা। প্রতিবাদে রাস্তা কেটে, গাছ ফেলে, গাড়ি ভাঙচুর করে আন্দোলনে নেমেছে লালগড়। এই পরিস্থিতিতে ছত্রধর যে-‘দিদি’‌কে ফোন করছিলেন, তিনি উত্তরা সিংহ। তৃণমূল নেত্রী এবং বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের সভাধিপতি।

তখন তৃণমূলের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে নিজের পরিচয় দিতেন ছত্রধর। মাওবাদী প্রভাবিত তল্লাটে থেকেও, মাওবাদী নেতা শশধরের দাদা হয়েও আপদে-বিপদে শরণ নিতেন ওই দলের নেতানেত্রীদেরই। তৃণমূল জমানায় মঙ্গলবার সেই ব্যক্তিরই যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হওয়ার পরে তাঁর পুরনো সঙ্গীদের অনেকে বলছেন, জেলে কয়েক জন মাওবাদী নেতার কুপরামর্শ শুনেই ডুবলেন ছত্রধর। তাঁদের মতে, ওই কুমন্ত্রণা শুনে ২০১১-র বিধানসভা ভোটে নির্দল প্রার্থী হিসেবে লড়াই করাটাই কাল হল ছত্রধর মাহাতোর। নির্বাচনে না-দাঁড়ালে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব কুপিত হতেন না, তাঁদের ‘ছত্রদার’ও হয়তো এই পরিণতি হত না।

Advertisement

‘দাদা’র সেই ভাইদের আক্ষেপ, পরিবর্তনের সরকার ছত্রধরকে জামিনে মুক্ত করার জন্য উদ্যোগী হতে পারত। প্রয়োজনে হয়তো তাঁর বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের বিষয়টিও বিবেচনা করা যেত। কিন্তু ছত্রধর যে নিজেই নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছেন, মানছেন তাঁর বিশ্বস্ত সঙ্গীরাও।

জেলে বসে কারা ‘কুমন্ত্রণা’ দিয়েছিলেন ছত্রধরের কানে?

ওই যুবকদের বক্তব্য, জেলে বসে মাওবাদী সংগঠনের প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক কাঞ্চন ওরফে সুদীপ চোংদার এবং মাওবাদী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে ধৃত রাজা সরখেল ও প্রসূন চট্টোপাধ্যায় ক্রমাগত ‘ভুল বুঝিয়ে’ ছত্রধরকে বিধানসভা ভোটে দাঁড়াতে রাজি করান। সেই সঙ্গে বাইরে থেকে অশোকজীবন ঘোষ নামে এক জন ধুয়ো দেন বলে জানাচ্ছেন ছত্রধরের পুরনো সহযোগীরা। অশোকজীবন একদা লালগড়ের আন্দোলনকারীদের পক্ষে বিবৃতি দিতেন।

বিশ্বস্ত সঙ্গীদের অনেককেই অবাক করে দিয়ে ছত্রধর গত বিধানসভা ভোটে ঝাড়গ্রাম কেন্দ্রে নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াবেন বলে জেল থেকে ঘোষণা করেন। তার আগেই ওই কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে সুকুমার হাঁসদার নাম ঘোষণা করে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লালগড় আবার ঝাড়গ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রেরই অন্তর্গত, যা ছত্রধরদের পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটিকে সামনে রেখে চালানো মাওবাদী আন্দোলনের ধাত্রীভূমি। সেই কেন্দ্র থেকেই নির্দল প্রার্থী হিসেবে ছত্রধরের দাঁড়িয়ে পড়ার অর্থ, বিরোধী ভোট ভাগ হয়ে আখেরে বামফ্রন্টেরই সুবিধে করে দেওয়া। অথচ ছত্রধর বরাবর নিজেকে ‘দিদি’ অর্থাৎ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ অনুগামী বলে পরিচয় দিতেন!

তৃণমূল যেখানে প্রার্থী দিয়েছে, মমতা-ঘনিষ্ঠ ছত্রধর সেখানে নির্দল হয়ে দাঁড়ালেন কী ভাবে?

ছত্রধরের এক পুরনো সঙ্গীর কথায়, ‘‘তখন কমিটির অস্তিত্ব প্রায় নেই। অশোকজীবন ঘোষ নামে নিজে মাতব্বর হয়ে বসা এক জন আমাদের বলল, মাওবাদী শীর্ষ নেতা কিষেণজির নির্দেশ, ছত্রদাকে ভোটে দাঁড়াতে হবে। ওঁর হয়ে আমাদের খাটতেও হবে। পরে জেলে গিয়ে দেখা করায় ছত্রদাও একই কথা বলল।’’

অথচ কিষেণজি যে এমন কোনও নির্দেশ দেননি, ছত্রধরেরই এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীর বক্তব্যে সেটা স্পষ্ট। ওই ছত্রধর-ঘনিষ্ঠ জানাচ্ছেন, বিধানসভা ভোটের পরে মাওবাদী নেতা কিষেণজি ও বিকাশ তাঁদের জিজ্ঞেস করেন, কে ছত্রধরকে ভোটে দাঁড়াতে বলেছিল? ওই যুবকের কথায়, ‘‘আমরা বলি, আপনারাই তো বলেছিলেন। ওঁরা বললেন, ‘ডাহা মিথ্যে। ভুল বার্তা দেওয়া হয়েছে। এখন ঠেলা সামলাও! ছত্রধর আর ছাড়া পেলে হয়!’ ঠিক তা-ই হল!!’’

ছত্রধরের গ্রেফতারির মাস দেড়েক পরে ডেবরার এক জনসভায় তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঘোষণা করেছিলেন, ছত্রধর মাহাতোকে তিনি কোনও দিনই জেল থেকে ছাড়বেন না। বুদ্ধবাবু এবং তাঁর দলকে ভোটে হারিয়ে ক্ষমতায় আসা, ছত্রধরের একদা শ্রদ্ধেয় ‘দিদি’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালে মেদিনীপুর আদালত মঙ্গলবার যে-রায় দিল, তাতে কিন্তু প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও সিপিএম নেতার সেই কথাটাই থেকে গেল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন