দেখা নেই খদ্দেরের। ঘুমোচ্ছেন বই বিক্রেতারা। কলেজ স্ট্রিটে। — নিজস্ব চিত্র
রবিশস্যের মরসুমে নোট বাতিল ও বদলের জটে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। সার বা শস্যবীজ কেনার জন্য পর্যাপ্ত নগদ টাকার জোগান নেই।
মার খাচ্ছে মানবজমিনের চাষও। সমস্যা দেখা দিয়েছে পাঠ্যবইয়ের জোগান নিয়ে। নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতে নতুন পাঠ্যবই ছেপে ঠিক সময়ে ছাত্রছাত্রীদের হাতে পৌঁছে দিতে হয় প্রকাশকদের। কিন্তু নগদ-লক্ষ্মীর অভাবে সরস্বতী-সাধনার সেই উপকরণ জোগানোর কাজটাও ব্যাহত হচ্ছে ভীষণ ভাবে।
তফাত এই যে, কৃষিকাজের বাধা হটাতে অন্তত শস্যবীজ কেনার ক্ষেত্রে পাঁচশো টাকার পুরনো নোট চলবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্র। কিন্তু বইয়ের ক্ষেত্রে সুরাহার পথ মিলছে না।
শুধু যে পাঠ্যবইয়ের প্রকাশকেরাই বিপাকে পড়েছেন, তা নয়। সামগ্রিক ভাবে সঙ্কটে পড়েছে প্রকাশনা শিল্প। এক দিকে নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরু তো অন্য দিকে বইমেলা। দুইয়ে মিলিয়ে বইপাড়ার কাছে এটা চূড়ান্ত ব্যস্ততার মরসুম। কিন্তু পাঁচশো আর হাজার টাকার পুরনো নোট বাতিলের ধাক্কায় পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ এবং বইমেলার প্রস্তুতি বিঘ্নিত হচ্ছে। প্রকাশকদের হিসেব অনুযায়ী বইয়ের বিক্রি কমে গিয়েছে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ।
মাথায় হাত পড়েছে কলেজ স্ট্রিটের পাঠ্যবই প্রকাশকদের। হাতে আছে সাকুল্যে দিন পঁচিশ সময়। এর মধ্যে যাবতীয় কাজ সেরে স্কুলের নতুন পাঠ্যবই বাজারে সরবরাহ করা যাবে কি না, তা নিয়ে ঘোর সংশয়ে রয়েছেন প্রকাশকেরা। কারণ, কৃষিতে শস্যবীজের জন্য পুরনো নোটকে ছাড়পত্র দেওয়া হলেও বইয়ের ক্ষেত্রে তেমন কোনও আশ্বাস মেলেনি।
রাজ্যের স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত নতুন বছরের ক্লাস শুরু হওয়ার কথা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই। সেই ক্লাসে নতুন পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়ার জন্য এই সময় ছাপার কাজে দিনরাত ব্যস্ত থাকতে হয় প্রকাশকদের। কিন্তু এ বার নগদ টাকার অভাবে বইয়ের কাগজ কেনা যাচ্ছে না। তাই ছাপার কাজও চলছে ঢিমেতালে।
মাধ্যমিক স্তরের বেশ কিছু পাঠ্যবই এবং পাঠ-সহায়িকা ছাপে, এমন একটি প্রকাশন সংস্থার কর্ণধার সুমিত বিশ্বাস জানান, পাঠ্যবই ছাপা হয় ফেলে দেওয়া ও নষ্ট কাগজ থেকে। ছাপাখানার মালিকদের তা কিনতে হয় নগদ টাকায়। কিন্তু নোট বাতিলের চোটে মার খাচ্ছে কাগজ কেনাবেচা। ‘‘প্রতি বছর ১৫ ডিসেম্বর নতুন পাঠ্যবই কেনা শুরু হয়ে যায়। এ বার পরিস্থিতি যা, তাতে নতুন বই কবে বাজারে আসবে, বুঝতে পারছি না,’’ বললেন সুমিতবাবু।
কলেজ স্ট্রিটের যে-সব সংস্থা মূলত মাদ্রাসার বই ছাপে, এই দুর্ভাবনার শরিক তারাও। এমনই এক সংস্থার মালিক রিয়াজুদ্দিন মিদ্দা জানান, এই সময় সহায়িকা বইয়ের খুব চাহিদা থাকে। কিন্তু নোট বাতিলের পর থেকে কেনাকাটা প্রায় বন্ধ। এর পরে বই ছাপবেন কী ভাবে, ভেবে কূল পাচ্ছেন না তিনি। ‘‘মাছকে ডাঙায় ছেড়ে
দিলে যা হয়, আমাদের এখন প্রায় সেই অবস্থা। নতুন শিক্ষাবর্ষের জন্য বই ছাপানোর রসদ কোথা থেকে আসবে, জানি না। বাজারে প্রচুর সংখ্যায় পাঁচশো টাকার নতুন নোট না-এলে এই সমস্যা মিটবে না,’’ বলছেন ওই প্রকাশক।
যাঁরা ডব্লিউবিসিএস এবং অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার বই ছাপেন, বিষম সমস্যায় পড়েছেন তাঁরাও। এতটাই যে, এ বার আর ওই সব বই প্রকাশ করবেন কি না, সেই বিষয়ে তাঁদের অনেকেই দোটানায়।
পাঠ্যবই ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার বইয়ের জরুরি প্রয়োজনের পাশাপাশি ঘাড়ে এসে পড়েছে বাঙালির বচ্ছরকার মনন-পার্বণ বইমেলা। সারা বছরে মোট যত বইয়ের ব্যবসা হয়, তার একটা বড় অংশ বিকোয় ওই মেলায়। কিন্তু বই ছাপানোর কাগজ কিনতে গিয়ে বিশেষ করে অসুবিধেয় পড়ছে ছোট প্রকাশন সংস্থা। এমনই একটি প্রকাশনীর তরফে মারুফ হোসেন জানালেন, তাঁরা বই ছাপানোর কাগজ কেনেন নগদ টাকায়। কিন্তু বই বিক্রি যে-ভাবে তলানিতে ঠেকেছে, তাতে পর্যাপ্ত নগদ হাতে আসছে না। প্রচুর পরিমাণে কাগজ কিনে ওঠাও সম্ভব হচ্ছে না। ‘‘এই অবস্থায় পরিকল্পনা অনুযায়ী সব বই শেষ পর্যন্ত এই বইমেলায় প্রকাশ করতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। যেগুলো নেহাত পারা যাবে না, আগামী পয়লা বৈশাখে সেই সব বই প্রকাশ করব। এ ছাড়া আর কোনও পথ নেই,’’ বললেন মারুফ।
অর্থাৎ সাধারণ ভাবে প্রতিটি বইমেলা যত নতুন বই পায়, এ বারের মেলা তত বই পাচ্ছে না। যেমন একটি প্রকাশন সংস্থা বইমেলায় ৭২টি নতুন বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা কিছু বই প্রকাশ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। ওই সংস্থার অন্যতম কর্তা সৌরভ মুখোপাধ্যায় জানান, এই মুহূর্তে বই বিক্রি প্রায় ৭০ শতাংশ কমে গিয়েছে। নগদের বিনিময়ে যাঁরা বই বাঁধাইয়ের কাজ করেন, তাঁদের টাকা দেওয়া যাচ্ছে না। বই নিয়ে যাওয়ার ভ্যান-ভাড়া দিতেও অসুবিধে হচ্ছে। সৌরভ বললেন, ‘‘এই পরিস্থিতিতে পরিকল্পনা থাকলেও সব বই এ বারের বইমেলায় প্রকাশ করা সম্ভব হবে না।’’ বই সরবরাহের খরচ, ভ্যানের ভাড়া মেটাতে খুব অসুবিধেয় পড়তে হচ্ছে বলে জানান অন্য একটি প্রকাশনীর প্রতিনিধি ঈপ্সিতা পালও।
নোটের চোট থেকে রেহাই পাচ্ছে না ছোটখাটো পত্রপত্রিকাও। নগদের টানাটানি চলতে থাকায় সাম্প্রতিক লিটল ম্যাগাজিন মেলাতেও তেমন ক্রেতা পাওয়া যায়নি।