বাসের মধ্যে ঘর। মশার কামড় এড়াতে সতর্কতা বাসকর্মীর। দক্ষিণ কলকাতায়। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
কাহিনি ১: উত্তর কলকাতা
বাড়ি বন্ধ ছিল দু’বছর। ফিরে আসার সপ্তাহ তিনেকের মধ্যে পরিবারের তিন জন জ্বরে বিছানা নিলেন। রক্ত পরীক্ষায় মিলল ডেঙ্গি। আশপাশেও কয়েক জন আক্রান্ত।
কোত্থেকে এল? জল তো জমেনি! এমনকী, বাড়ির লোক কলতলার চৌবাচ্চাও খালি করে গিয়েছিলেন! এসে আবার জল ভরেছেন। সে জল রোজ ব্যবহারও হচ্ছে।
কিন্তু পুরসভার লোক গিয়ে দেখে, চৌবাচ্চাতেই কিলবিল করছে এডিস মশার লার্ভা! কী
ভাবে সম্ভব?
ব্যাখ্যা দিয়েছেন কলকাতার পুরসভার ভেক্টর কন্ট্রোলের বিজ্ঞানীরা। ওঁরা জানাচ্ছেন, চৌবাচ্চায় জল ছিল না বটে, তবে তার ভিতরের দেওয়াল ভেজা ছিল। আর সেখানেই দিব্যি জমে ছিল এডিস মশার ডিম। পরে চৌবাচ্চায় জল ভরতেই ডিম ফুটে মশা জন্মেছে। ‘‘চৌবাচ্চা বা পাত্রের ভেজা দেওয়াল এডিস মশার আঁতুড়। ওখানে পাড়া ডিম অন্তত তিন বছর সক্রিয় থাকে। জল পেলেই ফুটে যায়।’’— মন্তব্য এক পতঙ্গবিদের।
কাহিনি ২: মধ্য কলকাতা
বহু দিনের ডেঙ্গি-মুক্ত পাড়ায় হঠাৎ বেশ কিছু বাসিন্দা প্রায় এক সঙ্গে জ্বরে পড়লেন। গায়ে অসম্ভব ব্যথা। রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গি ধরা পড়ল।
অথচ ওঁরা কেউ ইদানীং বাইরে যাননি! বাইরে থেকেও ডেঙ্গি নিয়ে কেউ পাড়ায় আসেনি! তা হলে?
তল্লাশিতে কয়েকটা বাড়ির বাড়ির জমা জলে মিলল এডিসের লার্ভা। পতঙ্গবিদেরা এসে পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী এডিস ধরে দেখলেন, সেগুলি ডেঙ্গি ভাইরাসে সংক্রমিত। কিন্তু কাছে-পিঠে রোগী না-থাকলে মশা জীবাণু
পেল কোত্থেকে?
রহস্যের সমাধান করেছেন পতঙ্গবিদেরাই। ওঁদের বক্তব্য: সংক্রমিত এডিসের ডিমের মধ্যেও ডেঙ্গি ভাইরাসের জিন ঢুকে যায়। ভাইরাসটি বংশানুক্রমে ঘুরতে থাকে। ফলে এক বার ভাইরাস পাওয়া কোনও এডিস মশার বংশধরদের ডেঙ্গি ছড়ানোর জন্য রোগীর দেহ থেকে জীবাণু নিতে হয় না। তারা জন্মায়ই ডেঙ্গির বাহক হয়ে।
কলকাতা পুরসভার পতঙ্গবিদ দেবাশিস বিশ্বাস বলেন, ‘‘এডিস ইজিপ্টাই তো বটেই, এনসেফ্যালাইটিসের জীবাণুবাহী কিউলেক্স বিশনোই মশাতেও ওই সব রোগ-জীবাণু পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত হয়। ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী এনোফিলিস স্টিফেনসাইয়ের অবশ্য সে ক্ষমতা নেই।’’
কাজেই ডেঙ্গির ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা অত্যন্ত জরুরি। এমনিতে ডেঙ্গির প্রতিষেধক বেরোয়নি। হু-র নির্দেশিকা মোতাবেক, মশার বংশ ধ্বংস ও কামড় এড়ানোই একমাত্র উপায়। ডেঙ্গির মশা পরিষ্কার জলে ডিম পাড়ে। ঘরের বাইরে জমে থাকা জলে, বাড়ির ভিতরে ফুলদানি, ফুলের টব, ফ্রিজের নীচের ট্রে— এ সব এডিসের মহা পছন্দ। আধো অন্ধকার, স্যাঁতসেতে জায়গায় পরিষ্কার জল পেলে তাদের বাড়বাড়ন্ত ঠেকায় কে?
এবং সমস্যাটা এখানেই। পুরসভা বা পঞ্চায়েতের তরফে বাড়ির অন্দরে বিশেষ নজর দেওয়া হয় না। ডেঙ্গিরোধী কর্মসূচিতে মূলত বাড়ির বাইরে কিংবা বাড়ির খোলা জায়গায় জমে থাকা পরিষ্কার জলে মশা মারার তেল স্প্রে করা হয়। দেখা হয় না, ভিতরের কোন ঘুপচিতে জমা পরিষ্কার জলে এডিস মশা ডেরা। এ ব্যাপারে মানুষকে সচেতনতার পাঠও পুরকর্মীরা সচরাচর দেন না বলে অভিযোগ।
পাশাপাশি ডেঙ্গি মোকাবিলায় ব্লিচিং পাউডারের ঢালাও ব্যবহার নিয়েও পতঙ্গবিদদের বিলক্ষণ আপত্তি। ওঁদের দাবি, খোলা পরিবেশে ঘুরে বেড়ানো জীবাণু দমনে ব্লিচিংয়ের জুড়ি মেলা ভার। তা থেকে নির্গত ক্লোরিনের তেজে উন্মুক্ত জীবাণুরা ধ্বংস হয়। কিন্তু মশা নিধনে ব্লিচিং পাউডারের বিশেষ ভূমিকা নেই। বিশেষত যে মশার আস্তানা গেরস্তবাড়ির ভিতরে।
তা হলে ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের নামে কলকাতা, সল্টলেক জুড়ে এন্তার ব্লিচিং ছড়ানোর মানে কী? কলকাতা পুরসভার এক কর্তা বলছেন, কাউন্সিলারেরা চান বলেই ছড়ানো হচ্ছে।
যেটাকে নেহাত অপচয় হিসেবে অভিহিত করছেন পতঙ্গবিদেরা। ‘‘উলুবনে ব্লিচিং ছড়ানোও বলতে পারেন।’’— কটাক্ষ এক বিজ্ঞানীর।