জলের তোড়ে হলদিয়া-ফরাক্কা বাদশাহি সড়কের উপর উল্টে গিয়েছে পণ্যবোঝাই লরি। রবিবার মুর্শিদাবাদের বড়ঞায় কৌশিক সাহার তোলা ছবি।
আচমকা কিঞ্চিৎ পিছু হটা বা থমকে যাওয়াটা কবাডির সাধারণ কৌশল। শুধু কবাডি কেন, সব খেলা আর যুদ্ধেই এই প্যাঁচ বেশ কাজে দেয়। এ ভাবে অস্ত্রশস্ত্র গুছিয়ে নিয়ে অচিরেই ফের ঝাঁপিয়ে পড়া যায় নতুন বিক্রমে।
নিম্নচাপের হুঙ্কার সত্ত্বেও রবিবার যে তেমন আকাশভাঙা বর্ষণ দেখা গেল না, তাতেও সেই কৌশল দেখছে হাওয়া অফিস। তাদের অতিবর্ষণের পূর্বাভাস ‘না-মেলা’য় এ দিন কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন মহানগরের পুরকর্তা এবং বাসিন্দারা। তাঁরা বলছেন, আবহাওয়া দফতর যতটা আশঙ্কা করছে, ততটা বোধ হয় হবে না। হাওয়া অফিস কিন্তু আশ্বস্ত হতে পারছে না, শোনাতে পারছে না আশ্বাসবাণীও। তাদের বক্তব্য, ‘ভাল’ মনে হলেও এটাই খারাপের ভূমিকা হতে পারে। কারণ, এটা নিম্নচাপের ভড়কি ছাড়া কিছু নয়। ‘‘এ দিনের ভাল আবহাওয়া কিন্তু খারাপ লক্ষণ, বলছেন আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ।’’
কেন?
আবহবিদদের বক্তব্য, গভীর নিম্নচাপটি সাগরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে শক্তি বাড়ানোর ফলে ক্রমাগত নিজের কেন্দ্রের দিকে হাওয়া টেনে চলেছে। তার ফলে দক্ষিণবঙ্গের পরিমণ্ডলের মেঘ ও জলীয় বাষ্প সরে গিয়েছে সাগরের দিকে। তার ফলে এ দিন তেমন জোরালো বৃষ্টি হয়নি ঠিকই। কিন্তু এই মেঘ-জলীয় বাষ্প টেনে অধিকতর শক্তিশালী হয়ে উঠে গভীর নিম্নচাপটি (তখন সে নেবে সুগভীর নিম্নচাপের চেহারা) দিন দুয়েক পরে স্থলভূমির দিকে ছুটে আসতে পারে। তখন কলকাতা-সহ উপকূলীয় জেলাগুলি ভারী থেকে অতি-ভারী বৃষ্টির কবলে পড়তে পারে বলে আবহবিদদের আশঙ্কা।
নিম্নচাপ। গভীর নিম্নচাপ। সুগভীর নিম্নচাপ। ধাপে ধাপে নিম্নচাপের শক্তি বাড়ানোর এই নিভৃত খেলাটা আমজনতার চোখে না-পড়লেও হাওয়া অফিসের নজর এড়াতে পারছে না। উপগ্রহ-চিত্র বিশ্লেষণ করে হাওয়া অফিস বলছে, জন্মের পরে ২৪ ঘণ্টা কাটার আগেই বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপ চেহারা বদল করে পরিণত হয়েছে গভীর নিম্নচাপে। শনিবার রাতে বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশ-পশ্চিমবঙ্গ উপকূলে দানা বেঁধেছিল সে। এবং রবিবার দুপুরেই হয়ে ওঠে গভীর নিম্নচাপ। বাংলাদেশ উপকূল থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে দাঁড়িয়ে ক্রমেই শক্তি বাড়িয়ে চলেছে সে। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তার সুগভীর নিম্নচাপে পরিণত হওয়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট। তার পরেই সে ধেয়ে আসতে পারে স্থলভূমির দিকে।
কোথাও কোথাও বৃষ্টি হলেও দিনভর ঝলমলে ছিল দার্জিলিং।
জলপাইগুড়ি শহর থেকে দেখা গিয়েছে ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
ছবিটি তুলেছেন রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়।
পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ উপকূলে ঘূর্ণাবর্তের এই আট ঘাট বেঁধে হামলা চালানোর উদ্যোগটা প্রথম ধরা পড়ে শুক্রবার রাতে। তখনই হাওয়া অফিস জানায়, কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে ভারী থেকে অতি-ভারী বৃষ্টি হতে পারে। একই বার্তা দিয়ে জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর নবান্নে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিল শনিবার। তার ভিত্তিতে তড়িঘড়ি বৈঠক ডাকে রাজ্য ও কলকাতা পুর-প্রশাসন। লন্ডন যাত্রার আগে দুর্যোগের পূর্বাভাসে ঘনিষ্ঠ মহলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন লন্ডনের উড়ান ধরতে বিমানবন্দরে ঢোকার মুখে তিনি বলেন, ‘‘আকাশ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। স্বরাষ্ট্রসচিবের নেতৃত্বে টাস্ক ফোর্স গড়ে দিয়েছি। তবে বেশি বাড়াবাড়ি হলে ফিরে আসব।’’
রবিবার সকালে কিন্তু অতি-ভারী বা ভারী, এমনকী জোরালো বৃষ্টিরও নামগন্ধ ছিল না। মেঘ জমলেও মাঝেমধ্যেই তা সরে গিয়ে বেরিয়ে আসছিল রোদ। আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস কেন মিলছে না, তা নিয়েও শুরু হয়ে যায় মুখরোচক জল্পনা। কিন্তু দুপুর থেকেই বৃষ্টি নামে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের বহু জায়গায়। আবহাওয়া দফতরের মাপকাঠিতে তা ভারী বা অতি-ভারী বৃষ্টির পর্যায়ে পড়ে না ঠিকই। কিন্তু শুক্রবারের বর্ষণেই মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমানের মতো দক্ষিণবঙ্গের অনেক জেলায় বানভাসি পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছে। ভারী বৃষ্টিতে এ বার কলকাতাও বানভাসি হতে পারে বলে আশঙ্কা।
গভীর নিম্নচাপ এ বারের হামলায় সঙ্গী হিসেবে পাচ্ছে দক্ষিণবঙ্গের উপরে সক্রিয় একটি নিম্নচাপ অক্ষরেখা এবং রাজস্থানের উপরে থাকা একটি নিম্নচাপকে। তার সেই জোড়া শাগরেদও শক্তি বাড়াচ্ছে। মৌসম ভবন জানিয়েছে, রাজস্থানের উপরকার নিম্নচাপটি শক্তি বাড়িয়ে আজ, সোমবার গভীর নিম্নচাপের চেহারা নিতে পারে। ওই নিম্নচাপ থেকে বেরিয়ে একটি নিম্নচাপ অক্ষরেখা দক্ষিণবঙ্গ হয়ে বঙ্গোপসাগরের গভীর নিম্নচাপের হাত ধরেছে। সব মিলিয়ে আজ কলকাতা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
জোড়া শাগরেদ ততটা আশঙ্কার নয়। ভয় বেশি গভীর নিম্নচাপটিকে নিয়েই। আবহবিদদের অনেকেই বলছেন, নিম্নচাপ অক্ষরেখা তো সক্রিয় রয়েছেই। তার উপরে সাগরের ‘অতিথি’ ওই গভীর নিম্নচাপ দক্ষিণবঙ্গের দিকে ধেয়ে এলে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা ষোলো আনা। শুক্র-শনিবারের বৃষ্টির জেরে এমনিতেই দক্ষিণবঙ্গের বহু জেলায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
মুর্শিদাবাদের কান্দি মহকুমায় শনিবার সন্ধ্যা থেকেই সালার-কান্দি রাজ্য সড়ক ও হলদিয়া-ফরাক্কা বাদশাহি সড়কের উপর দিয়ে বইছে কুঁয়ে নদীর জল। ফলে বীরভূম, বর্ধমান, কাটোয়া, দুর্গাপুর-সহ বিভিন্ন রুটের বাস বন্ধ হয়ে যায়। কান্দি-সালার রুটের বাস চলাচলও বন্ধ। সেচ দফতর সূত্রের খবর, কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে তিলিপাড়া জলাধারে জল বেড়ে যাওয়ায় প্রথমে ১২ হাজার এবং পরে সাত হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়। নদীতে অতিরিক্ত জল এসে পড়ায় দু’কূল প্লাবিত হয়ে তৈরি হয় বন্যা পরিস্থিতি।
বীরভূমের লাভপুরেও কুঁয়ে নদীর বাঁধ ভেঙে প্রায় ৪৫টি গ্রাম জলমগ্ন। ক্ষতিগ্রস্ত তিন হাজারেরও বেশি মাটির বাড়ি। পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী পৌঁছয়নি বলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। লাভপুরের বিডিও জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, ‘‘গ্রামগুলিতে ত্রাণ পাঠানোর চেষ্টা চলছে। গ্রামের আইসিডিএস কেন্দ্রগুলিতে মজুত খাদ্যসামগ্রী রান্না করে বিলি করতে বলা হয়েছে এলাকার জনপ্রতিনিধিদের।’’ প্রবল বর্ষণে সাঁইথিয়া ও মহম্মদবাজার ব্লকে পাঁচ শতাধিক বাড়ি ভেঙেছে। ৩০টিরও বেশি গ্রাম প্লাবিত। তবে শনিবার থেকে তেমন বৃষ্টি না-হওয়ায় ওই সব এলাকায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। লাগাতার বৃষ্টিতে বীরভূমের ১৮ হাজার হেক্টর ধান খেত এবং পাঁচ হাজার হেক্টর বীজতলা জলের তলায়।
বন্যার মুখে বর্ধমানের একাংশও। বৃষ্টির জল জমে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে কালনা-১ ব্লকের সুলতানপুর, পূর্বস্থলীর নাদনঘাট প্রভৃতি এলাকা। বাঁকা নদীর জল উপচে মন্তেশ্বরের প্রায় ৪০টি গ্রামে বহু বাড়িঘর ভেসে গিয়েছে। কুঁয়ে নদীর বাঁধ ভেঙে জলমগ্ন হয়েছে কেতুগ্রামের আনখোনা পঞ্চায়েত এলাকার বেশ কয়েকটি গ্রাম। বাসিন্দারা বাড়ি ছেড়ে প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। কয়েকশো পরিবারকে ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হয়েছে বলেও প্রশাসনের দাবি। চাকটা-কোমরপুরে বাদশাহি সড়কের উপর দিয়ে জল বইতে থাকায় বেশ কিছু এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।