দু’বছরের আগে তাঁকে বদলি করা যাবে না সুপ্রিম কোর্টের এমন রক্ষাকবচ রয়েছে রাজ্য পুলিশের ডিজি-র। তা-ও কেন হাইকোর্টে দাঁড়িয়ে রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডি পাড়ুই-কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত, তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে আড়াল করলেন? শাসক দলের সুরেই কথা বলে তিনি কি ডিজি পদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করলেন না? আদালতে বৃহস্পতিবার ডিজি-র ভূমিকা দেখার পর থেকে এই প্রশ্ন উঠছে প্রশাসনিক মহলের একাংশে। সরব হয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিও। দাবি উঠেছে ডিজি-র পদত্যাগেরও।
রেড্ডির পূর্বসূরিদের একাংশ অবশ্য বর্তমান ডিজি-র এ দিনের ভূমিকায় বিস্মিত নন। তাঁদের প্রশ্ন, রাজ্যের প্রশাসনিক কর্ণধার প্রধান স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী একাধিক বার পাড়ুই-কাণ্ডের অভিযুক্তদের মঞ্চে নিয়ে তাঁদের হয়ে সওয়াল করেছেন। সেখানে ডিজি কী ভাবে ভিন্নমত পোষণ করবেন? রাজ্যের প্রাক্তন ডিজি তথা অধুনা বিজেপি নেতা রঞ্জিতকুমার মহান্তির কথায়, “সরকার যাঁরা চালান, তাঁরা যা চান, ডিজি আদালতে তাই বলেছেন। সরকারের বক্তব্যই আদালতে বলেছেন ডিজি।” বিরোধীদের অভিযোগ করছেন, শাসক দলের সুরে কথা বলতে গিয়ে নিচু তলার পুলিশকর্মীদেরই বিপদের মুখে ফেললেন পুলিশের শীর্ষ কর্তা।
ডিজি জি এম প্রভু রাজাশেখর রেড্ডি এ সব মন্তব্যের জবাব দিতে চাননি। কেন তিনি অনুব্রতকে আড়াল করলেন, সেই প্রশ্নে ডিজি-র জবাব, “বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন। তাই আমি এ ব্যাপারে মন্তব্য করব না।”
প্রশাসনিক মহলের একাংশ বলছে, প্রাক্তন আইপিএস অফিসার প্রকাশ সিংহের মামলায় ২০০৬ সালে সুপ্রিম কোর্ট সুপারিশ করেছিল, প্রতিটি রাজ্যের ডিজিপি-র কার্যকালের মেয়াদ দু’বছর বেঁধে দেওয়া হোক। যাঁরা মাঠে নেমে কাজ করেন, সেই সব আইজি, ডিআইজি এবং এসপি-দেরও দু’বছরের আগে বদলি করা যাবে না বলে সুপারিশ করে সর্বোচ্চ আদালত। তা জেনেও ডিজি রেড্ডি কেন মূল অভিযুক্ত অনুব্রতকে আড়াল করলেন? রাজ্যের প্রাক্তন ডিজি ভূপিন্দর সিংহের মতে, “ডিজি সিটের প্রধান। ওই সিট পাড়ুই মামলার তদন্ত করেছে। তদন্তে যা পাওয়া গিয়েছে, তাই হয়তো আদালতে বলেছেন ডিজি। তবে তিনি ভুল বললে, আদালত তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।”
কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদারের প্রতিক্রিয়া কিছুটা কড়া। তিনি বলেছেন, “হাইকোর্টে ডিজি-র এই আচরণ পদের জন্য আনুগত্য। পদ হারানোর ভয়েই হয়তো ডিজি এমনটা বলতে বাধ্য হয়েছেন।” কিন্তু ডিজি-র তো সুপ্রিম কোর্টের রক্ষাকবচ রয়েছে! তুষারবাবুর ব্যাখ্যা, “পুলিশ রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত। তাই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও বিশেষ কারণ দেখিয়ে ডিজি-কে সরাতেই পারে রাজ্য। তা জানেন বলে ডিজি যা করণীয়, তাই করেছেন!”
প্রধান বিরোধী দল সিপিএমের সাংসদ মহম্মদ সেলিম এই প্রসঙ্গেই প্রাক্তন ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়ের উদাহরণ টেনেছেন। তাঁর মন্তব্য, “ডিজি-র হয়তো তড়িঘড়ি পদ হারানো বা বদলির ভয় নেই। কিন্তু এই জমানায় পুলিশ-কর্তারা অবসরের পরের পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে চাইছেন। শাসক দলের চোখে ভাল কাজ করে প্রাক্তন এক ডিজি যেমন মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্ব পেয়েছেন!”
বীরভূমেরই বোলপুর থানায় বুধবার রাতে হামলা চালিয়ে পুলিশকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল-আশ্রিত দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। সেই দুষ্কৃতীদের নেতাকেই হাইকোর্টে ডিজি ‘ক্লিন চিট’ দেওয়ায় পুলিশকর্মীদের কাছে ভুল বার্তা গিয়েছে বলে মনে করছেন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহও। রাহুলবাবু বলেন, “এই ব্যক্তির ডিজি থাকার নৈতিক অধিকার নেই!” অধীর চৌধুরীর অভিযোগ, রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনকে দিয়ে সরকার ‘যেন তেন প্রকারেন’ অপরাধীদের রক্ষা করার চেষ্টা করছে!
প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার তুষারবাবু অবশ্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ-কর্তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার কথাও বলেছেন। তাঁর ব্যাখ্যা, এক একটা সময় আসে যখন শাসক দল এবং আইনের বই এই দুইয়ের মাঝখানে এসে পড়তে হয় কোনও পুলিশ-কর্তাকে। তখন কাকে বেশি প্রাধান্য দেবেন, সেটা সেই পুলিশ-কর্তার সিদ্ধান্তের উপরে নির্ভর করে। তুষারবাবুর উদাহরণ, “যেমন জয়রামন। তিনি আইনের বইকে শাসক দলের উপরে রেখেছিলেন।” শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন পর্ষদের (এসজেডিএ) বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তে শিলিগুড়ির তৎকালীন পুলিশ কমিশনার কারিয়প্পা জয়রামন ওই সংস্থার প্রাক্তন চেয়ারম্যান, আইএএস গোদালা কিরণ কুমারকে গ্রেফতার করেন। তাই তাঁকে ‘কমপালসারি ওয়েটিং’-এ যেতে হয়। ডিজি রেড্ডি এ দিন অনুব্রতকে আড়াল করে হাইকোর্টে বিবৃতি দেওয়ার পরে পাড়ুইয়ে নিহত সাগর ঘোষের ছেলে হৃদয় ঘোষ ফের সিবিআই তদন্তের দাবি তুলেছেন।