ঠাকুমার কোলে পুষ্পার পাঁচ মাসের ছেলে আয়ুষ।—নিজস্ব চিত্র।
মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে ক’দিন আগে। হাতে খানিকটা ফাঁকা সময়। দিন সাতেক আগে দুই বন্ধু ঠিক করে, সকালের দিকে পাড়ার পুকুরে নেমে দাপাদাপি করে বেশ খানিকটা সময় কাটানো যাবে। প্রায় সমবয়সী পাড়ার তরুণী বধূটিও যোগ দেন তাদের সঙ্গে। তারপর থেকে পুকুরের বাঁধানো পাড়ে বসে সকালের দিকে বেশ খানিকটা সময় কেটে যেত শ্রাবণী-পায়েল-পুষ্পাদের। কিন্তু বুধবার সকালে সেই পুকুরে ডুবেই মৃত্যু হল তিন জনের। ঘটনাটা চোখে দেখেনি কেউ। তবে পাড়া-পড়শিদের অনুমান, কোনও এক জনকে জলে তলিয়ে যেতে দেখে বাকিরা তাকে উদ্ধারের চেষ্টা করেছিল। যার পরিণতিতে এমন ঘটনা।
ঘটনাস্থল উত্তরপাড়া থানার কোন্নগরের নবগ্রাম সি-ব্লকের বিধানপল্লি এলাকা। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, শ্রাবণী ঘোষ (১৫) নামে মেয়েটি এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল নবগ্রাম শিশুভারতী স্কুল থেকে। ছোটবেলায় তার বাবা মারা গিয়েছেন ক্যানসারে। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে অভাবের সংসার মা সবিতাদেবীর। মাথা গোঁজারও কোনও জায়গা নেই তখন পরিবারটির কাছে। কাছেই একটি বৃদ্ধাশ্রমে কাজ পেয়ে যান সবিতা। সেখানেই দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে ওঠেন। সবিতাদেবীর কথায়, “মেয়ে সাঁতার জানত না। কিন্তু ক’দিন ধরেই বলছিল, পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। সময় আর কাটতে চাইছে না। পুকুরে স্নান করতে চায়। আমি আপত্তি করিনি।”
পুকুরই যে মেয়ের প্রাণ কাড়বে, তা এখনও যেন বিশ্বাস কে র উঠতে পারছেন না পায়েল হোড়ের (১৮) বাড়ির লোকজন। মেয়েটি এ বারই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে নবগ্রাম সত্যভারতী স্কুল থেকে। তাদেরই বাড়িতে স্বামী আর পাঁচ মাসের ছেলেকে নিয়ে নিয়ে ভাড়া থাকতেন পুষ্পা সিংহ (২০)। আদি বাড়ি বিহারের নালন্দায়।
পায়েলের বাবা তাপসবাবু ছোটখাট কাজ করেন কলকাতার দোকানে। জানালেন, দিন সাতেক হল পাড়ার বন্ধুদের জুটিয়ে পুকুরে স্নান করতে যাচ্ছিল মেয়ে। সাঁতার না জানলেও তাপসবাবুরা ভেবেছিলেন, এক সঙ্গে আছে ক’জন। এতে বিপদের আর কী থাকতে পারে! এ দিনও পৌনে ৯টা নাগাদ মেয়েকে শ্যাম্পুর শিশি হাতে স্নানে বেরোতে দেখেছিলেন তাপসবাবু। তারপরে নিজেও বেরিয়ে যান কাজে। পরে খবর পেয়ে যখন ফিরলেন, ততক্ষণে একমাত্র মেয়ের দেহে আর প্রাণ নেই। স্ত্রীর আকষ্মিক মৃত্যুতে পাঁচ মাসের একরত্তি ছেলে আয়ুষকে নিয়ে বিহ্বল পুষ্পার স্বামী পিন্টু সিংহও।
কী ঘটেছিল এ দিন সকালে?
পাড় বাঁধানো পুকুরটির শেষের কয়েকটি ধাপ বেশ পিছল। কচুরিপানাও আছে। আশপাশ ঝোপ-জঙ্গলে ঘেরা। পাড়ার তেমন কেউ ব্যবহার করেন না এই পুকুর। পাশ দিয়ে একটি ঢালাই রাস্তা গিয়েছে। এ দিন সকাল পৌনে ১০টা নাগাদ সেখান দিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় কয়েকজন পড়ুয়ার নজরে পড়ে, জলে এক তরুণীর দেহ ভাসছে। তাদের চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে আসে। পুকুরে নেমে তারাই তোলে তিন তরুণীর দেহ। স্থানীয় কানাইপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকেরা সকলকেই মৃত ঘোষণা করেন। পরে পুলিশ দেহগুলি ময়না-তদন্তের জন্য পাঠায় শ্রীরামপুর ওয়ালশ হাসপাতালে।