রাঙাডিহা গ্রামে আদিবাসী মেয়েদের ফুটবল দলের সঙ্গে জেলাশাসক। —নিজস্ব চিত্র।
কেউ দিনমজুর। কেউবা পড়ুয়া। কারও বয়স ১২। আবার কেউ এক ছেলের মা। কিন্তু, একটি জায়গায় সকলেই এক— বিকেলে পায়ে ফুটবল নিয়ে মাঠের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌড়ে বেড়ান ওঁরা।
অন্তরের তাগিদ থেকেই একদা মাও-অধ্যুষিত পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সাঁকরাইল ব্লকের রাঙাডিহা গ্রামের তফসিলি জন জাতির কিশোরীরা মেতেছিলেন ফুটবলে। বর্তমান সরকারের জঙ্গলমহল কাপ সেই উৎসাহে ইন্ধনও জুগিয়েছে। জঙ্গলমহল কাপে একবার চ্যাম্পিয়ানও হয়েছিল ‘সাঁকরাইল পুলিশ স্টেশন মহিলা ফুটবল দল’। পাইকাতেও (পঞ্চায়েত ক্রীড়া ও খেল অভিযান) এই খেলোয়াড়রাই রাজ্যস্তরে জেতে। কলকাতায় অনুর্ধ্ব ১৬তে বাংলার হয়েও একবার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন এই দলেরই ৪ জন। স্থানীয় স্কুল শিক্ষক শান্তনু ভৌমিকের কথায়, “ওই সাফল্যগুলি থেকেই বোঝা ওঁদের যায় প্রতিভা রয়েছে। কিন্তু ওঁরা যে দু’বেলা পেটের জোগাড় করতেই হিমশিম খায়। খেলায় কত দিন যে ধরে রাখা যাবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।” তাঁর প্রস্তাব, “যদি ওঁদের কলকাতায় রেখে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেত, তা হলে আমাদের প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েরা একদিন বাংলা কেন দেশের হয়েও প্রতিনিধিত্ব করতে পারত।”
বর্তমানে প্রায় ২৫ জন কিশোরী দলের সদস্য। সকলকে জার্সি, জুতো কিনে দেওয়া, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পাঠানো— সব খরচই দেন গ্রামের কয়েক জন ব্যক্তি। তাতেও কী সহজে সকলকে মাঠে নামানো গিয়েছিল। গ্রামের মেয়ে জার্সি পরে ছুটে বেড়াবে! লজ্জায় কান লাল উঠেছিল তথাকথিত সমাজপতিদের। প্রতিবন্ধকতার সেই শুরু। তারপর যে মাঠে খেলা হয় মাঠেরও অবস্থা খুব ভাল নয়। মাঠে নেই পানীয় জল, নেই ড্রেসিং রুম, নেই শৌচাগারও। অলচিকি লিপির পার্শ্বশিক্ষিকা সুনীতা মুর্মুুর কথায়, “স্কুল করে, তিন বছরের বাচ্চা সামলানোর পরও মাঠে আসি ফুটবল ভালবাসি বলে।” সুনীতার আক্ষেপ, শুধু নিজেদের গ্রাম নয় পাশাপাশি অনেক গ্রামের মেয়েরাই ফুটবল ভালবাসে। কিন্তু প্রতিভাবানদের যদি উপরে ওঠার জন্য কোনও সাহায্য না মেলে তা হলে একদিন সকলেই হতাশ হয়ে যাবেন।
শুধু এই খেলোয়াড়রাই নয়, এমন আশঙ্কা রয়েছে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। সম্প্রতি ঝাড়গ্রামে জঙ্গলমহল কাপের পুরষ্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রায় ৩২ হাজার খেলোয়াড়ে ভর্তি ঝাড়গ্রাম স্টেডিয়ামে পাশে ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রকে রেখে বলেছিলেন, “আমি শুরু করলাম। এটা চালিয়ে যেতে হবে। এঁদের প্রত্যেককে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে খেলার ব্যবস্থা করতে হবে।” পরে জঙ্গলমহলের বিভিন্ন জায়গায় ‘ক্রীড়া চর্চা কেন্দ্র’ করারও কথা বলেন তিনি। যেখানে একটি ঘর থাকবে, থাকবে খেলার বিভিন্ন সরঞ্জামও। যাতে খেলোয়াড়েরা উৎসাহিত হয়। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাতে এ রকম ২২-২৫টি কেন্দ্র করা হবে বলে জেলাশাসক গুলাম আলি আনসারি জানিয়েছেন। তবে রাঙাডিহার ক্ষেত্রে অবশ্য আগে ইন্টিগ্রেটেড অ্যাকশন প্ল্যান থেকে একটি ড্রেসিং রুম করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল আগেই। তারই সঙ্গে পানীয় জল, প্রস্রাবাগার— সব কিছুই থাকবে। জেলাশাসক বলেন, “এই কাজগুলি আমরা দ্রুত করার জন্য উদ্যোগী হচ্ছি।”
প্রশিক্ষক থেকে সাধারণ মানুষ জানাচ্ছেন, অনেক প্রতিকূলতাকে জয় করে এগিয়ে চলার ইতিহাস গড়ছে দলটি। তাই এই প্রশংসা ওঁদের প্রাপ্য। যেমন মমতা হাঁসদা ও মুক্তা হাঁসদা। দলের যে চার সদস্যের জন্য বাংলা দলে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছিল তাদের মধ্যে এই দুই বোনও রয়েছে। তখন তারা কলকাতায় সরোজিনী নাইডু ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আর্থিক অনটনে তারপর আর কলকাতায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। বাবা মারা গিয়েছেন। মা কণিকাদেবী পঞ্চায়েত অফিসের ঠিকাকর্মী। কাজ মিললে টাকা। তাই সংসার চালাতে মুক্তাকেও লোকের বাড়িতে কাজ করতে হয়। সারাদিন কাজ করে মেলে ১০০ টাকা! একশো দিনের প্রকল্পে মজুরি বেশি হলেও ১৮ বছর বয়স না হওয়ায় জব কার্ড মেলেনি। তাই সংসার চালানোর তাগিদে কম মজুরিতেই অন্যের জমিতে কাজ করতে বাধ্য হন। ছোট বোন অবশ্য নবম শ্রেণির ছাত্রী। কোচ তথা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শম্ভুনাথ মাণ্ডির কথায়, “আমিও এক সময় কলকাতার এ ডিভিসন লিগে খেলেছি। তাই বুঝি খেলার জন্য কত পরিশ্রম করতে হয়। আর পরিশ্রম করলে ভাল কিছু না মিলুক পেট ভরে তো খেতে হবে। এখানে সেটাও সবার জোটে না।” সাই থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া স্থানীয় বাসিন্দা তথা এই ফুটবল দলের অন্যতম প্রশিক্ষক অশোক সিংহ মনে করেন, প্রতিভাবানদের ভাল জায়গায় খেলা ও সেখান থেকে অর্থোপার্জনের সুযোগ করে না দিলে খেলায় আগ্রহ কমবে।
এখন মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ক্রীড়ামন্ত্রী এ ব্যাপারে কী পদক্ষেপ করেন সেটাই দেখার। তার উপরেই জঙ্গলমহলের খেলার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে বলে খেলোয়াড় ও এলাকাবাসীর অভিমত। সাঁকরাইলের বিডিও সৌরভ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “সত্যিই খুব কষ্ট সয়েই খেলা চালিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা। চেষ্টা করছি যদি কিছু সাহায্য করা যায়।”