হাওড়ায় দুর্ঘটনার পরে জনরোষের ছবি। পুলিশের দিকে তেড়ে যাচ্ছে মারমুখী জনতা।
রাস্তার ধার দিয়ে যাওয়া মোটরবাইকে ধাক্কা দিয়েছিল প্রথমে। তার পরেই রাস্তা থেকে ২০ ফুট দূরের গাছে ধাক্কা মেরে টালির চালের এক বাড়ির দেওয়াল ভেঙে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে গেল বিশাল ট্রেলার। চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে কিছুক্ষণের জন্য হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন পথচারী ও স্থানীয় লোকজন। বিকট আওয়াজে হুঁশ ফিরতেই ছুটে গিয়ে দেখলেন ট্রেলার ও ভাঙা ইটের স্তূপের মাঝে আটকে রয়েছেন শিশু কোলে এক প্রৌঢ়া। পিষ্ট দু’জনেই। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। শুক্রবার সকালে এমনই ঘটনার সাক্ষী রইল শিবপুরের ব্যাতাইতলা।
হাওড়ার শালিমার স্টেশন রোডের উপরে এই ঘটনার পরে তড়িঘড়ি মোটরবাইক আরোহী-সহ তিন জনকেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রৌঢ়া ও দেড় বছরের শিশুটিকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা। পুলিশ জানায়, মৃতার নাম আশা সিংহ (৫৫), শিশুটি তাঁর নাতনি পিঙ্কি সিংহ। আব্দুল মান্নান নামে ওই মোটরবাইক-আরোহী হাসপাতালে ভর্তি। বেপরোয়া গতিতে চলা ট্রেলার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এমন দুর্ঘটনা ঘটানোর পরে কার্যত রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় গোটা এলাকা। চলে দফায় দফায় অবরোধ, বিক্ষোভ, এমনকী পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতিও। পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও লাঠি, রড নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় পুলিশের তিনটি মোটরবাইকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে নামে র্যাফ ও পুলিশের বিশাল বাহিনী। বিক্ষোভকারীদের হঠাতে লাঠি চালাতে হয়। আটক করা হয় এক যুবককে।
কী ঘটেছিল এ দিন?
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ শালিমার স্টেশনের দিক থেকে একটি ফাঁকা বড় ট্রেলার বেপরোয়া ভাবে তীব্র গতিতে ব্যাতাইতলা ফাঁড়ির দিকে যাচ্ছিল। সেই সময়ে শালিমার স্টেশন রোডে রাস্তার ডান দিক দিয়ে চলা এক মোটরবাইকে আচমকা পিছন থেকে ধাক্কা মারে ট্রেলারটি। ছিটকে পড়েন মোটরবাইক চালক। এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ট্রেলারটি আরও তীব্র গতিতে রাস্তার ধারের নর্দমা পার করে প্রায় ২০ ফুট দূরে একটি গাছে গিয়ে ধাক্কা মারে। কিন্তু তাতেও না থেমে সোজা ঢুকে পড়ে আরও কিছুটা দূরের একটি টালির চালের বাড়িতে।
ওই বাড়িতে সেই সময়ে কয়েকটি বাচ্চাকে পড়াচ্ছিলেন কল্যাণী দাস নামে এক মহিলা। পড়ার শেষে নাতিকে নিয়ে বাড়ি যাবেন বলে বাড়ির সামনেই অপেক্ষা করছিলেন আশাদেবী। তাঁর কোলেই ছিল দেড় বছরের নাতনি পিঙ্কি। তাঁদের বাড়ি ঘটনাস্থল থেকে কিছুটা দূরে, জিটি রোডে। ট্রেলারটি ওই বৃদ্ধা ও তাঁর নাতনিকে নিয়েই দেওয়াল ভেঙে বাড়িটির ভিতরে ঢুকে পড়ে। কল্যাণীদেবীর বৌদি শেফালি পাল বলেন, “ভাগ্যিস পড়ানোর ঘরে ট্রেলারটি ঢোকেনি। তা হলে আরও বড় কিছু ঘটে যেত!”
ট্রেলারটি যখন মোটরবাইকে ধাক্কা মারে, তখন রাস্তার ধারের একটি দোকানে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিনোদ মাহাতো। তিনি বলেন, “হঠাৎ দেখি ট্রেলারটি বাইকে ধাক্কা মারল। তার পরেই চোখের নিমেষে গাছে ধাক্কা মেরে ঢুকে গেল বাড়িটার ভিতরে।” ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক হয়ে গেলেও বিকট আওয়াজে সম্বিৎ ফেরে। বাড়িটির দিকে ছুটে যান বিনোদবাবু ও অন্য পথচারীরা। ভাঙা দেওয়ালের ভিতর থেকে মহিলা ও শিশুটিকে উদ্ধার করতে গেলে দেওয়ালের বাকি অংশও ভেঙে পড়ে। মাথায় চোট পান বিনোদবাবু। এর পরেই স্থানীয়েরা ট্রেলারের চালককে বেধড়ক মারধর শুরু করেন। পুলিশ এসে আব্দুল মান্নান, আশাদেবী ও পিঙ্কিকে হাওড়া জেলা হাসপাতালে নিয়ে যায়।
ব্যাতাইতলা ফাঁড়ির সামনেই পুড়ছে পুলিশের মোটরবাইক। শুক্রবার।
ঘটনাস্থল থেকেই ঢিল-ছোড়া দূরত্বে ব্যাতাইতলা ফাঁড়ি। সেখান থেকে দুই পুলিশকর্মী এসে কোনওক্রমে উন্মত্ত জনতার হাত থেকে ট্রেলার-চালককে উদ্ধার করে ফাঁড়িতে নিয়ে যান। অন্য দিকে, ঘটনার খবর ছড়াতেই শয়ে শয়ে মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েন বিক্ষোভ দেখাতে। অভিযোগ, এক দল লোক ফাঁড়িতে গিয়ে দাবি করেন, চালককে তাঁদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। এর পরেই বিক্ষোভকারীরা ফাঁড়িতে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করে। ফাঁড়ির সামনে থাকা তিনটি মোটরবাইকেও আগুন ধরানো হয় বলে অভিযোগ। দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে থাকলেও ভিতরে পুলিশ কার্যত নীরব দর্শকের ভূমিকায় বসে ছিল। এ দিন অবরোধ করা হয় শালিমার স্টেশন রোডও।
ঘটনার খবর হাওড়া সিটি পুলিশের সদর কার্যালয়ে পৌঁছনো মাত্রই বিশাল পুলিশবাহিনী ও র্যাফ নিয়ে ঘটনাস্থলে যান পুলিশকর্তারা। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে তাঁদের হাতাহাতি বেধে যায়। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, প্রতিদিনই ওই রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের মদতে বেআইনি ভাবে লরি-ট্রাক পার্কিং করা হয়। এ দিনও ওই ট্রেলারটি পার্ক করা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশের দাবি মতো টাকা না দেওয়ায় ট্রেলারটির কাগজপত্র নিয়ে নিতে যান পুলিশকর্মীরা। তখনই তীব্রগতিতে ট্রেলারটি চালিয়ে ব্যাতাইতলা মোড়ের দিকে পালাচ্ছিলেন চালক। তার জেরেই দুর্ঘটনা ঘটে।
প্রথমে বিক্ষোভকারীদের বুঝিয়েসুঝিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু পুরুষ ও মহিলা বিক্ষোভকারীরা তা মানতে চাননি বলে অভিযোগ। তাঁরা লাঠি, রড, বাঁশ নিয়ে অবরোধে নেমে পড়েন। শালিমার স্টেশন রোডের পাশাপাশি জিটি রোডও অবরোধ করা হয়। এর মধ্যেই এক যুবককে গোলমাল ছড়ানোর অভিযোগে আটক করে পুলিশ। এতেই বিক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ করা হয়।
তবে হাওড়ার ডিসি (ট্রাফিক) অজয় ঠাকুর ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা অনিয়মের অভিযোগ মানতে চাননি। তাঁর দাবি, “অভিযোগ ঠিক নয়। পুলিশ কেন টাকা নিতে যাবে? কেনই বা তাড়া করবে? বিক্ষোভকারীরা আগুন ধরিয়ে ভাঙচুর করেছেন ফাঁড়িতে। সে ঘটনা চাপা দিতেই ওঁরা এ সব মিথ্যা কথা বলছেন।”
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান জেলার তৃণমূল নেতারা। পৌঁছন ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর সৈকত চৌধুরীও। তিনি বলেন, “ঘটনাটি অনভিপ্রেত। এখানে ঠিকঠাক ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।” পরে ঘটনাস্থলে যান হাওড়া পুরসভার চেয়ারম্যান অরবিন্দ গুহ। অভিযোগ, সেই সময়ে সংবাদমাধ্যমের উপরেও চড়াও হন বিক্ষোভকারীরা। দুপুর ১টা পর্যন্ত দফায় দফায় বিক্ষোভের পরে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এলাকায় পুলিশ-পিকেট বসেছে।
ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।