স্ত্রী থ্যালাসেমিয়া বাহক, বিচ্ছেদের আবেদন চিকিত্সক স্বামীর!

কলকাতার মেয়ে বিয়ের পরে ডাক্তার স্বামীর কাছে থাকার জন্য গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের পিটারবরোতে। অভিযোগ, সেখানে যাওয়ার পরেই স্বামীর ব্যবহারে কিছু বদল লক্ষ করেন।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০১৮ ০৪:১১
Share:

কোনও খাবার নেই বাড়িতে। বাইরে বরফ পড়ছে। অথচ একটা জ্যাকেট কেনার টাকাও নেই হাতে। স্বামী নিজের মতো বাড়ি এসে খেয়েদেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। বাধ্য হয়ে ধাক্কা দিয়েছিলেন পাশের বাড়ির দরজায়। অভিযোগ, এক দিন নয়, দিনের পর দিন প্রতিবেশীদের কাছে চেয়েচিন্তে দু’বেলা খাবার জুটেছিল। ২৮ বছরের নবনীতা সরকার বসু বলছিলেন, ‘‘পাঁচ বছর আগের সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে এখনও দম বন্ধ হয়ে আসে।’’ তাঁর এই যাবতীয় দুর্ভোগের কারণ একটাই। তিনি থ্যালাসেমিয়া বাহক।

Advertisement

কলকাতার মেয়ে বিয়ের পরে ডাক্তার স্বামীর কাছে থাকার জন্য গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের পিটারবরোতে। অভিযোগ, সেখানে যাওয়ার পরেই স্বামীর ব্যবহারে কিছু বদল লক্ষ করেন। প্রথমে কিছু ভাঙতে না চাইলেও পরে চিকিৎসক স্বামী জানান, বিদেশ আসার আগে নবনীতার রক্তের যে সব পরীক্ষা হয়েছিল, তাতে ধরা পড়েছে, তিনি থ্যালাসেমিয়ার বাহক। তাতে কী? নবনীতা বলেন, ‘‘সাধারণ মানুষের মধ্যে হয়তো এ নিয়ে ভুল ধারণা থাকতে পারে। কিন্তু আমার স্বামী তো ডাক্তার। তিনি কেন এমন ভাবছেন? জিজ্ঞাসা করে জেনেছিলাম, উনি থ্যালাসেমিয়ার বাহক নন। আর স্বামী-স্ত্রী দু’জনে যদি বাহক না হন, তা হলে তো সন্তানেরও ঝুঁকি নেই। তা হলে উনি কেন আমার সঙ্গে এমন করছেন? উত্তর পাইনি। শুধু জানিয়েছিলেন, আমার সঙ্গে সংসার করা ওঁর পক্ষে সম্ভব নয়।’’ নবনীতার অভিযোগ, দিনের পর দিন মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরে আসেন তিনি।

এর পরে নবনীতার স্বামী আদালতে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা করেন। ‘থ্যালাসেমিয়া লুকিয়ে’ বিয়ে দিয়ে তাঁকে ঠকানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। যদিও পাঁচ বছরে সেই মামলার সওয়াল-জবাব শুরু হয়নি। বিভিন্ন কারণ জানিয়ে সময় চেয়েছেন নবনীতার স্বামী, চিকিৎসক অরিজিৎ বসু। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার নবনীতা আপাতত একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তাঁর কথায়, ‘‘জীবনটাকে নতুন করে শুরু করার চেষ্টা করছি। কিন্তু যে অপমান আমাকে এবং আমার পরিবারকে সহ্য করতে হচ্ছে, সেটা ভুলব কী করে?’’ রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় মহিলা কমিশনে এ ব্যাপারে বিস্তারিত অভিযোগ জানিয়েছেন তিনি।

Advertisement

নবনীতা জানিয়েছেন, টানা পাঁচ বছর ধরে চলছে তাঁর লড়াই। তাঁর কথায়, ‘‘আমার বাবা তাঁর সঞ্চয়ের অনেকটা অংশ বিয়েতে খরচ করেছিলেন। সবটাই জলে গিয়েছে। বিয়েতে দেওয়া গয়নার একটাও ফেরত পাইনি। এমনকি, বিয়েতে দেওয়া খাটটাও ওই বাড়িতেই থেকে গিয়েছে। বাদ পড়েছি শুধু আমি।’’ নবনীতা বলেন, ‘‘সামাজিক ভাবে নানা অসম্মানের মুখোমুখি হয়ে চলেছি এতগুলো বছর। কেন আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে দিলেন, কোন ধরনের মারাত্মক রোগের শিকার আমি, সমাজে সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে জেরবার হয়ে যাচ্ছি এখনও।’’

বিদেশের পাট চুকিয়ে আপাতত কলকাতাতেই থাকেন মনোরোগ চিকিৎসক অরিজিৎবাবু। এক জন চিকিৎসক হয়েও তিনি কি জানেন না থ্যালাসেমিয়ার বাহক হওয়া কোনও গুরুতর বিষয় নয়? অরিজিৎবাবুর জবাব, ‘‘এ নিয়ে কোনও কথাই বলতে রাজি নই।’’

থ্যালাসেমিয়া রোগীদের নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের তরফে শৈলেন ঘোষ বলেন, ‘‘আমাদের দীর্ঘদিনের এত প্রচার, এত লড়াইকে এক ধাক্কায় অনেকখানি পিছিয়ে দেয় এই সব ঘটনা। ডাক্তাররাও যদি এমন করেন, তা হলে আর কাকে বলব?’’

থ্যালাসেমিয়া রুখতে বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা নিয়ে এখন লাগাতার প্রচার চলে। কিন্তু আদতে রোগটা সম্পর্কে মানুষের মনোভাব সেই তিমিরেই রয়েছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। হেমাটোলজিস্ট প্রান্তর চক্রবর্তী জানান, বিটা থ্যালাসেমিয়া বাহক হওয়াটা কোনও রোগ নয়। এ রাজ্যের জনসংখ্যার ১০ শতাংশই এর বাহক। এর জন্য স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনে সমস্যার প্রশ্নই নেই। তিনি বলেন, ‘‘স্বামী-স্ত্রী দুজনে বাহক না হলে কোনও সমস্যাই নেই। আর যদি দুজনে বাহক হন, তা হলে সন্তানের ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে ২৫ শতাংশ। সেটাও গর্ভাবস্থায় পরীক্ষা করে জেনে নেওয়া সম্ভব। ধরা প়ড়লে ভারতীয় আইন মেনেই গর্ভপাত করানো যেতে পারে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এখনও কতটা পিছিয়ে আছি, তা ভেবে ডাক্তার হিসেবে লজ্জা হচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন