হাসপাতালের ভিতরে পুলিশবাহিনী। মঙ্গলবার। — নিজস্ব চিত্র
রাতভর রণক্ষেত্র এসএসকেএম হাসপাতাল!
যুযুধান দু’পক্ষের মধ্যে একটি দল হল এক মৃত রোগীর আত্মীয়-প্রতিবেশী এবং হাসপাতালের এক দল অস্থায়ী চতুর্থ শ্রেণির কর্মী (যাঁদের অবশ্য হাসপাতালের দালাল বলেই দাবি করেছেন সেখানকার চিকিৎসকেরা)। আর অন্য দল, জুনিয়র ডাক্তারদের একটি বড় অংশ।
জ্বর নিয়ে রবিবার ভর্তি হওয়া এক যুবকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে শুরু হয় তুমুল গোলমাল। ওঠে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ। যার জেরে সোমবার রাত এগারোটার পর থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত দফায় দফায় মারমুখী দু’পক্ষ বাঁশ, লাঠি, হকি স্টিক নিয়ে তেড়ে গিয়েছেন পরস্পরের দিকে। পুলিশের সামনেই একে-অন্যের দিকে ছুড়ে দিয়েছেন ইট, কাচের টুকরো। চলেছে গালাগালি আর হুমকির ফোয়ারা।
ম্যাকেঞ্জি ওয়ার্ডে কর্তব্যরত ইন্টার্ন কৌস্তুভ মাইতি-সহ মোট পাঁচ জন জুনিয়র ডাক্তারকে রোগীর বাড়ির লোকজন মারধর করেছেন বলে চিকিৎসকেরা অভিযোগ করেন। তাঁদের বক্তব্য, রোগীর পরিজনদের সঙ্গে হাসপাতালের এক দল দালালও হামলার ঘটনায় যুক্ত ছিলেন। রোগীর বাড়ির লোকেদের আবার পাল্টা অভিযোগ— মৃতের দাদা এবং দুই পড়শিকে ম্যাকেঞ্জি ওয়ার্ডের ডক্টর্স রুমে আটকে রেখে বেধড়ক পিটিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তারেরা।
ঘটনার পরে ভবানীপুর থানায় দায়ের হয় দু’টি অভিযোগ। একটিতে এসএসকেএমের সুপার করবী বড়াল অভিযোগ করেছেন, রোগীর বাড়ির লোকের সঙ্গে আসা সঞ্জয় দাস ওরফে সঞ্জু, শুভঙ্কর দাস ও রতন রামের বিরুদ্ধে। অন্যটিতে সঞ্জয় দাস মারধরের অভিযোগ এনেছেন সুজন ঘোষ ও সৈকত মণ্ডল নামে দুই জুনিয়র ডাক্তারের বিরুদ্ধে।
এ দিন ভোরেই সঞ্জয়, শুভঙ্কর ও রতনকে পুলিশের হাতে তুলে দেন হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ। গ্রেফতার করা হয় তাঁদের। তবে আহত হওয়ায় সঞ্জয়কে এসএসকেএমে ভর্তি করা হয়েছিল। মঙ্গলবার বিকেলেই অবশ্য জামিন পেয়ে যান ওই তিন জন। অন্য দিকে, ভোরে বেশ কিছুক্ষণ এবং পরে বিকেলের পর থেকে টানা কয়েক ঘণ্টা এসএসকেএমের অধ্যক্ষ মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘেরাও করে রাখেন জুনিয়র ডাক্তরদের একাংশ। অবিলম্বে হামলাবাজদের গ্রেফতার ও চিকিৎসকদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ পুলিশকর্মীদের শাস্তি দিতে হবে বলে দাবি জানান তাঁরা। সাধারণত, এমন পরিস্থিতিতে কর্মবিরতির পথেই যেতে দেখা যায় জুনিয়র ডাক্তারদের। এ দিন এসএসকেএমে তা হয়নি। মঙ্গলবার সার্বিক ভাবে রোগী পরিষেবাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কাজকর্ম চলেছে স্বাভাবিক। তবে ঘটনাকে কেন্দ্র করে আলোচনা ও উত্তেজনা ছিল দিনভর।
এসএসকেএম হাসপাতাল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধানসভা এলাকার ভিতরে। তার উপরে যে রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে গোলমালের সূত্রপাত, সেই অশোক রামের বাড়িও মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভা এলাকার মধ্যে, ভবানীপুরের বিজয় বসু রোডে। জ্বরে ভুগছিলেন অশোকবাবু। রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট আসার কথা ছিল মঙ্গলবার। এ ছাড়া সোমবার অজানা জ্বরে কলকাতায় যে দু’জনের মৃত্যু হয়েছিল, তাঁরা একই পাড়ার লোক। সব মিলিয়ে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন দুপুরে নিজেই পৌঁছে যান এসএসকেএমে।
তিনি প্রথমেই জরুরি বিভাগে যান এবং হাসপাতালের পরিকাঠামো দেখেন। মানুষের ভিড়ের সামনেই প্রকাশ্যে কড়া গলায় হাসপাতালের অধ্যক্ষ, সুপার ও অন্য কর্তাদের দায়িত্বশীল হওয়ার ও চটজলদি পরিস্থিতি মোকাবিলার নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। হাসপাতালে পরিষেবা পেতে সাধারণ মানুষের যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, সে দিকে নজর দিতে বলেন কর্তাদের। নবান্ন সূত্রে খবর, পরে তিনি স্বাস্থ্যসচিব রাজেন্দ্র শুক্লকে বলেছেন, চিকিৎসকদের এ রকম আচরণ কখনওই বরদাস্ত করা হবে না। শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে মারমুখী ইন্টার্নেরা যাতে রেজিস্ট্রেশন না পান, সে ব্যবস্থাও নেওয়া হতে পারে। নবান্ন ও স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, এসএসকেএমের ঘটনায় জুনিয়র ডাক্তারেরা যে ভাবে লাঠিসোঁটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন, তাতে প্রশাসন অত্যন্ত বিরক্ত। তারা বিষয়টিকে সহজ ভাবে নিচ্ছে না।
এ দিন বিজয় বসু রোডের বস্তিতে মৃত অশোক রামের বাড়ি গেলে সেখানেও আত্মীয়-পড়শিরা জুনিয়র ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। অশোকবাবুর বোন রাধা রাম, মা লক্ষ্মী রাম ও প্রতিবেশী ময়না দাসের কথায়, ‘‘আমাদের ছেলে মারা গিয়েছে। আমরা নিজেদের সামলাব, না ডাক্তারদের মারতে যাব! ডাক্তারবাবুদের জিজ্ঞাসা করতে গিয়েছিলাম, তরতাজা ছেলেটা কেন মারা গেল? তাতে খেপে উঠে ওঁরা আমাদের সঙ্গে থাকা তিন জনকে ঘরে আটকে মারতে লাগলেন। ওঁদের কাজ মানুষের চিকিৎসা করা, নাকি মারা?’’
তবে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন ক্ষুব্ধ জুনিয়র ডাক্তারেরাও। বলেছেন, ‘‘রাতে হাসপাতালে কোনও নিরাপত্তা নেই আমাদের। হাতেগোনা কিছু পুলিশ দর্শক হয়ে থাকে। আমরা কেন বারবার বলির পাঁঠা হব? যার যখন খুশি আমাদের পিটিয়ে যাবে আর আমরা মার খেয়ে মরব? প্রতিবাদ করব না?’’ তাঁদের আরও বক্তব্য, ‘‘রোগীর বাড়ির লোক সেজে আসলে এক দল দালাল হামলা চালিয়েছে। আত্মরক্ষায় তাঁদের পাল্টা মার দেওয়া কি অন্যায়? মুখ্যমন্ত্রী হাসপাতালগুলির প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারছেন না বলে আমাদের দোষ দেখছেন। স্বাস্থ্য দফতরও তাঁকে ভুল বোঝাচ্ছে।’’
স্বাস্থ্যকর্তারা অবশ্য জানাচ্ছেন, চিকিৎসকদের সঙ্গে হামলাকারীদের পার্থক্য থাকা উচিত। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে গোলমাল থামানোর চেষ্টা না করে উল্টে জুনিয়র ডাক্তারেরাও বাঁশ-লাঠি নিয়ে তেড়ে যান। তাঁদের শরীরী ভাষা ছিল উগ্র। পুলিশকে উদ্দেশ করেও তাঁরা নানা রকম মন্তব্য করেছেন। সমস্যা মেটানোর জায়গায় সমস্যা বাড়িয়েছেন। ডাক্তারদের কাছ থেকে এমনটা প্রত্যাশিত নয়।