মুখ্যমন্ত্রী একটু দেখবেন কি, ডাক্তারদের আর্জি

ছুড়ে ছুড়ে জাবনা খাবার মনোরোগীদের

পরপর সাজানো ট্রে। তাতে গলে মণ্ড হয়ে যাওয়া ভাতের উপরে একসঙ্গে ডাল-ঝোল-তরকারি সবই ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। ছুড়ে ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে মাছের টুকরো। যেন লক্ষ্যভেদের প্রতিযোগিতা! মাঝেমধ্যেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে মাছের টুকরো পড়ে যাচ্ছে মেঝেতে। ফের ট্রে-তে তুলে দেওয়া হচ্ছে সেটাই। ট্রে-তে ডাল-মাছের ঝোল-তরকারি এমন ভাবে জোট ও ঘোঁট পাকাচ্ছে যে, কোনটার কী স্বাদ, আলাদা করে বোঝার উপায় নেই।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ ০৩:৪৯
Share:

গ্লাস বা কাপের বদলে খোপ কাটা ট্রে-তে এ ভাবেই রোগীদের দুধ দেওয়া হয় বহরমপুর মানসিক হাসপাতালে। আর সেই দুধের মধ্যেই ফেলে দেওয়া হয়েছে এক খণ্ড পাউরুটি, কলা, ডিম। — নিজস্ব চিত্র

•পরপর সাজানো ট্রে। তাতে গলে মণ্ড হয়ে যাওয়া ভাতের উপরে একসঙ্গে ডাল-ঝোল-তরকারি সবই ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। ছুড়ে ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে মাছের টুকরো। যেন লক্ষ্যভেদের প্রতিযোগিতা! মাঝেমধ্যেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে মাছের টুকরো পড়ে যাচ্ছে মেঝেতে। ফের ট্রে-তে তুলে দেওয়া হচ্ছে সেটাই। ট্রে-তে ডাল-মাছের ঝোল-তরকারি এমন ভাবে জোট ও ঘোঁট পাকাচ্ছে যে, কোনটার কী স্বাদ, আলাদা করে বোঝার উপায় নেই।

Advertisement

• গ্লাস নয়। কাপও নয়। দুধ দেওয়া হচ্ছে খোপ কাটা ট্রে-তে। ট্রে উপচে ট্যালটেলে দুধ গড়িয়ে পড়ছে ওয়ার্ড জুড়ে। আর সেই দুধের মধ্যে ভাসছে এক খণ্ড পাউরুটি, একটা কলা এবং ডিমসেদ্ধ। রান্নাঘর থেকে রোগীর হাতে যখন তা পৌঁছচ্ছে, তত ক্ষণে কলা আর রুটি দুধে মিশে প্রায় কাদা। কোনও মতে গলা দিয়ে ঢুকিয়ে পেট ভরাতে বাধ্য হচ্ছেন রোগীরা।

দু’চার দিন নয়। মাসের পর মাস এ ভাবেই খাবার দেওয়া হচ্ছে বহরমপুর মানসিক হাসপাতালে। রোগীর পথ্য জোগানোর মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব এ ভাবে পালন করার মধ্যে মানসিক রোগীদের প্রতি চূড়ান্ত অবজ্ঞা আর অবহেলার মনোভাবই প্রকাশ পাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।

Advertisement

দিনের পর দিন চোখের সামনে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে আর স্থির থাকতে পারেননি ওই হাসপাতালের কিছু ডাক্তার। সটান ছবি তুলে তাঁরা পাঠিয়ে দিয়েছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে। পাঠিয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের কাছেও। তাঁদের প্রশ্ন, মনোরোগীদের কি ন্যূনতম মর্যাদাটুকুও দেওয়া যায় না? মানুষ তো পোষ্য প্রাণীদেরও অনেক যত্ন করে খাবার দেয়। মনোরোগীদের এত তাচ্ছিল্যভরে খাবার দেওয়া হবে কেন? খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এর বিহিত চেয়েছেন তাঁরা।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধিরা জানুয়ারির মাঝামাঝি বহরমপুর মানসিক হাসপাতালের পরিস্থিতি দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। পুরুষ রোগীদের ওয়ার্ডে ঢুকে তাঁদের নজরে পড়েছিল, অনেকেরই পরনে পোশাক নেই। এই নিয়ে হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষকে তাঁরা তিরস্কারও করেছিলেন বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর। এ বার কমিশনে চিঠি পাঠিয়ে ডাক্তারেরা বলেছেন, ওখানে খাবারের মান এবং খাবার পরিবেশনের সামগ্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই অমানবিকতা রয়েছে।

এক চিকিৎসক জানান, মানসিক রোগীরা অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ জায়গায় প্রতিবাদ করতে পারেন না। তাই তাঁদের সঙ্গে এমন আচরণ করার সাহস পান হাসপাতালের কর্মীরা। ‘‘এখানে সব সময়েই দেখছি, প্রায় ছুড়ে ছুড়ে খাবার দেওয়া হচ্ছে রোগীদের। বহু বার কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ফল হয়নি। তাই এ বার ছবি-সহ উপর মহলে অভিযোগ করলাম। দেখা যাক, সুরাহা হয় কি না,’’ বললেন ওই চিকিৎসক

ওই হাসপাতালে রোগীদের সঙ্গে আচরণে চূড়ান্ত ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে কমিশনের অভিযোগ। কমিশনের এক সদস্য বলেন, ‘‘বিস্তারিত ভাবে খোঁজখবর নিচ্ছি। ওখানে অনেক ক্ষেত্রেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলে আমাদের মনে হয়েছে। সব দিক খোঁজ করে সবিস্তার রিপোর্ট তৈরি হবে।’’

রোগীদের খাবারটুকু দেওয়ার ক্ষেত্রেও এমন ব্যবহারের কারণ কী? হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ কী বলেন?

জবাবের বদলে পাল্টা প্রশ্ন করেন হাসপাতালের সুপার পবিত্র সরকার। বলেন, ‘‘গ্লাস, কাপ সবই তো মজুত আছে। তা সত্ত্বেও ট্রে-তে দুধ দেওয়া হবে কেন?’’ তাঁকে বলা হল, এর উত্তরটা তো হাসপাতালের প্রধান হিসেবে তাঁরই জানার কথা। তিনি বলেন, ‘‘বিচ্ছিন্ন ভাবে কোনও এক দিন হয়তো কোনও রোগীকে ট্রে-তে দুধ দেওয়া হয়েছে। আর কেউ সেটা ছবি তুলে পাঠিয়ে দিয়েছে। নিয়মিত এ-রকম হয় না। আমাদের ডায়েট কমিটি রয়েছে। নজরদারি চলে।’’

সুপারের দাবি উড়ে গিয়েছে তাঁর হাসপাতালের নার্সদেরই জোরালো অভিযোগের হাওয়ায়। তাঁরা জানাচ্ছেন, এ ভাবে রোগিদের খাবার দেওয়াটা এখানে মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটাই এখানকার দস্তুর। প্রতিবাদ করে লাভ হয় না। ‘‘খাবার নিয়ে যা-তা চলছে। দিন কয়েক আগেই মাছের বদলে সপ্তাহে তিন দিন ডিম দেওয়া হল। দু’‌বেলা ডিম খেয়ে একাধিক রোগীর পেটের গোলমাল শুরু হল। ডায়েট কমিটি যদি ঠিকঠাক কাজ করত, তা হলে কি এমন হতে পারত,’’ প্রশ্ন এক নার্সের।

ক্ষমতায় আসার পরে রাজ্যে মানসিক স্বাস্থ্যের হাল ফেরাতে একটি কমিটি তৈরি করেছিল তৃণমূল সরকার। সেই কমিটি এই অমানবিক আচরণ নিয়ে কিছু বলছে না কেন?

খোঁজ করতে গিয়ে জানা গেল, কমিটি গড়াই সার। তাদের নিয়মিত বৈঠকে বসার ব্যাপারটাই কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছে। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘সবটাই চলছে গয়ংগচ্ছ মনোভাব নিয়ে। কয়েক বছর আগে পাভলভ হাসপাতালে রোগিণীদের নগ্ন করে রাখার বিষয়টি সামনে আসার পরে কলকাতা হাইকোর্ট একটি কমিটি গড়ে দেয়। সেই কমিটি মানসিক হাসপাতালগুলি নিয়মিত পরিদর্শন করত। কিছু দিন সব ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু তার পরে সেই কমিটি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।’’

একই হাল সরকারের গড়া কমিটির। যাদের দায়িত্ব মানসিক স্বাস্থ্যের হাল ফেরানো, সেই কমিটি নিয়মিত বৈঠকেও বসে না। হাসপাতালের কর্মীরা রোগীদের খাবার দেওয়ার বেলায় যে-অবহেলা, যে-উদাসীনতা দেখাচ্ছেন, বৈঠকে বসার পাট শিকেয় তুলে দিয়ে সরকারি কমিটি কি তার থেকে কিছু কম অবহেলা দেখাচ্ছে— উঠছে প্রশ্ন।

‘‘রোগীদের সঙ্গে এমন ব্যবহার চূড়ান্ত অবমাননার সামিল। নিয়মিত নজরদারি থাকলে হয়তো এটা এড়ানো যেত,’’ বলছেন রাজ্য সরকারের গড়া কমিটির অন্যতম সদস্য
মোহিত রণদীপ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন