সিবিআই থাবা রাজ্যেও

সারদা কাণ্ডে গ্রেফতার ইস্টবেঙ্গল-কর্তা

সারদা-কাণ্ডে এ রাজ্যে ধরপাকড় শুরু করল সিবিআই। তাদের প্রথম শিকার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্মকর্তা দেবব্রত সরকার ওরফে নিতু। ১৪ অগস্ট তাঁর পূর্ব সিঁথি রোডের বাড়িতে তল্লাশি করে কিছু নথি আটক করেছিল সিবিআই। আটক নথির সঙ্গে নিতুর বয়ান না-মেলায় বুধবার তাঁকে তলব করা হয় সিবিআই দফতরে। দীর্ঘ সময় জিজ্ঞাসাবাদের পরেও নিতুর বয়ানে অসঙ্গতি না-কাটায় সন্ধ্যায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা ও নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৪ ০৩:১৯
Share:

গ্রেফতারের পরে। সিবিআই দফতর থেকে বিধাননগর উত্তর থানার পথে দেবব্রত সরকার (নিতু)। বুধবার রণজিৎ নন্দীর তোলা ছবি।

সারদা-কাণ্ডে এ রাজ্যে ধরপাকড় শুরু করল সিবিআই।

Advertisement

তাদের প্রথম শিকার ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কর্মকর্তা দেবব্রত সরকার ওরফে নিতু। ১৪ অগস্ট তাঁর পূর্ব সিঁথি রোডের বাড়িতে তল্লাশি করে কিছু নথি আটক করেছিল সিবিআই। আটক নথির সঙ্গে নিতুর বয়ান না-মেলায় বুধবার তাঁকে তলব করা হয় সিবিআই দফতরে। দীর্ঘ সময় জিজ্ঞাসাবাদের পরেও নিতুর বয়ানে অসঙ্গতি না-কাটায় সন্ধ্যায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। আজ, বৃহস্পতিবার তাঁকে আলিপুর আদালতে হাজির করানো হবে।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তভার হাতে নেওয়ার পরে ১৬ অগস্ট ওড়িশার কংগ্রেস নেতা সমদিত কুন্তিয়াকে গ্রেফতার করে সিবিআই। সেই অর্থে নিতু সিবিআইয়ের দ্বিতীয় শিকার। ১৪ তারিখ নিতুর পাশাপাশি রাজ্যের বেশ কয়েক জন প্রভাবশালী ব্যক্তির বাড়িতে তল্লাশি চালান সিবিআই। তার মধ্যে তৃণমূল ঘনিষ্ঠ প্রাক্তন আইপিএস অফিসার রজত মজুমদারও আছেন।

Advertisement

নিতু গ্রেফতার হওয়ার পর এই আর্থিক কেলেঙ্কারির তদন্তে পরপর বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি গ্রেফতার হতে পারেন বলে সিবিআই সূত্রের খবর। কেন্দ্রীয় সংস্থার গোয়েন্দারা বলছেন, সারদা কেলেঙ্কারিতে নিতু হচ্ছেন একটি কান। তাঁকে টানলেই মাথা আসবে। অর্থাৎ নিতুকে জেরা করেই আরও প্রভাবশালীদের পাকড়াও করা হতে পারে বলেই তাঁদের ইঙ্গিত।

নিতুর বিরুদ্ধে প্রাথমিক ভাবে সিবিআই অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র এবং তহবিল তছরুপের অভিযোগ এনেছে। কলকাতা থেকে কাশ্মীরে পালানোর আগে সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেন সিবিআই-কে যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, তাতে তিনি অভিযোগ করেন, নিতুর সঙ্গে সেবি-র কয়েক জন কর্তার দহরম মহরম রয়েছে। তাই সেবিকে ‘ম্যানেজ’ করার জন্য নিতুকে কয়েক দফায় তিনি মোটা টাকা দিয়েছেন।

নিতুর সঙ্গে সঙ্গে ময়দানের আরও কয়েকটি ক্লাব এবং তাঁদের কর্তাদের জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়নি সিবিআই। সারদা তদন্তে এর আগে মোহনবাগান কর্তা সৃঞ্জয় বসুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল ইডি (এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট)। কিন্তু নিতুই ময়দানের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে এই কেলেঙ্কারিতে গ্রেফতার হলেন। সিবিআই সূত্রের খবর, নিতুর কাছ থেকে ময়দানের আর একটি ক্লাবে টাকা যাওয়ার কথাও তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন। সেই ক্লাবের সঙ্গে শাসক দলের এক সাংসদ ও মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন ঘনিষ্ঠ এক নেতা যুক্ত। এ বার তা নিয়েও নিতুকে জেরা করা হবে। প্রভাবশালীদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়ার চেষ্টাও করবেন গোয়েন্দারা।

সুদীপ্তর অভিযোগ

“ সেবি, কোম্পানি নিবন্ধক এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্তাদের সঙ্গে সারদার মধ্যস্থতাকারী ছিলেন নিতু। এদের নাম করে ভয় দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে টাকাও আদায় করতেন।”

সিবিআইয়ের অভিযোগ

• তহবিল তছরুপ

• অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র।

এর পাশাপাশি সেবি এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতো নিয়ামক সংস্থাগুলির ভূমিকাও খতিয়ে দেখবে সিবিআই। সারদায় সিবিআই তদন্ত দেওয়ার কথা জানানোর সময় সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, নিয়ামক সংস্থাগুলির ভূমিকা খতিয়ে দেখা হোক। সিবিআই সূত্রের খবর, তদন্তে ইতিমধ্যেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এক অবসরপ্রাপ্ত কর্তা, কোম্পানি নিবন্ধকের এক জন এবং সেবি-র তিন কর্তার নাম উঠে এসেছে। তাঁদের টাকা যেত এক ‘মিডলম্যান’-এর মাধ্যমে। সুদীপ্তের অভিযোগ অনুযায়ী, নিতু-ই সেই ‘মিডলম্যান’। ১৪ তারিখ তল্লাশির সময় নিতুর বাড়ি থেকে সেবি-কে লেখা চিঠিও উদ্ধার হয়েছে বলে সিবিআই সূত্রে খবর। মিলেছে ২৫ লক্ষ টাকার একটি ফিক্সড ডিপোজিট, যা নিয়ে নিতু সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি, দাবি গোয়েন্দাদের। আগে নিতুকে রাজ্য পুলিশও জেরা করে। কিন্তু তারা কেন কোনও প্রমাণ বা কথাবার্তায় অসঙ্গতি পেল না, প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে তা নিয়েও।

সারদা-তদন্তে পিছিয়ে নেই ইডি-ও। ইতিমধ্যেই রাজ্যের বস্ত্রমন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও অভিনেত্রী অপর্ণা সেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে তারা। ইডি সূত্রের খবর, রাজ্যের আরও তিন মন্ত্রী এবং শাসক দলের এক সাংসদকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায় তারা। এ ব্যাপারে ব্যাঙ্কশাল আদালতে আবেদন জানিয়েছে ইডি। ইডির অফিসারদের ধারণা, সারদার সঙ্গে ওই তিন মন্ত্রীর আর্থিক লেনদেন হয়েছিল। সেই সংক্রান্ত কিছু নথিও উদ্ধার করা হয়েছে। ইডি সূত্রের খবর, সারদার একাধিক কর্মচারী ও হিসাবরক্ষককে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গিয়েছে, ওই তিন মন্ত্রী সারদার কাছ থেকে নানা ভাবে লাভবান হন। এক প্রভাবশালী মন্ত্রীকে সারদার বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও দেখা গিয়েছে। তিনি মাঝেমধ্যে সারদার মিডল্যান্ড পার্ক অফিসেও যেতেন। সারদার কাছ থেকে তিনি কয়েকটি গাড়ি নিয়েছেন বলেও তদন্তকারীরা জানাচ্ছেন। রাজ্যের এক মন্ত্রী তথা দক্ষিণবঙ্গের আর এক বিধায়কের সম্পর্কেও কিছু তথ্য মিলেছে। তৃণমূলের এক সাংসদও সারদার থেকে লাভবান হয়েছেন বলে ইডি সূত্রের খবর। তাই টাকা পাচারের তদন্তে ওই তিন মন্ত্রী এবং সাংসদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন বলেই ইডির কর্তারা মনে করছেন। এক এক প্রভাবশালী ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার ব্যাপারেও তারা চিন্তাভাবনা করছে।

সারদা কেলেঙ্কারির মধ্যমণি সুদীপ্ত সেনকে এর মধ্যেই একাধিক বার জেরা করেছে ইডি। এ দিনই সারদা কনস্ট্রাকশনের মামলায় সুদীপ্তকে নিজেদের হেফাজতে চেয়ে আলিপুর আদালতে আর্জি জানিয়েছে তারা। একই দিনে নিতুর গ্রেফতার ও সুদীপ্তকে হেফাজতে নিতে চাওয়ার আবেদন তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। এ বার দু’জনকে আলাদা ঘরে একই সময়ে জেরা করা হতে পারে। তাতে দু’জনের বয়ানের ফাঁক বেরোবে বলেই সিবিআই মনে করছে।

ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রয়াত কর্তা পল্টু দাসের হাত ধরে ১৯৭৬-’৭৭ সালে ময়দানে আসেন নিতু। ধীরে ধীরে ক্লাবে ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন। চিকিৎসা সামগ্রীর পারিবারিক ব্যবসা থাকলেও দিনরাত ক্লাবেই পাওয়া যায় তাঁকে। ময়দান সূত্রের খবর, ১৯৯১ সালে এএফসি কাপ খেলতে জাপান গিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। সঙ্গে যান বহু সমর্থক। অভিযোগ, তাদের অনেকেই আর দেশে ফেরেননি। ময়দানে ‘জাপান কেলেঙ্কারি’ নামে পরিচিত সেই ঘটনায় নিতুর নাম উঠে এসেছিল। ক্লাবের তরফে তিনিই ভিসার বিষয়টি দেখেছিলেন বলে অভিযোগ।

ময়দানের লোকেরা বলছেন, প্রথম থেকেই রাজনৈতিক যোগাযোগ জোরালো ছিল নিতুর। পল্টু দাসের সূত্রেই মধ্য কলকাতার এক দাপুটে কংগ্রেস নেতার ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। বাম আমলে তাঁর যোগাযোগ গড়ে ওঠে সিপিএমের এক শীর্ষ নেতা এবং এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর আপ্ত-সহায়কের সঙ্গে। এক সময় আলিমুদ্দিনে নিয়মিত দেখা যেত তাঁকে। রাজ্যে পালাবদলের পর নিতু তৃণমূলের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। সেই মন্ত্রীর সঙ্গে সারদারও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল বলে অভিযোগ। ইদানীং নিতুকে রাজ্যের আর এক প্রভাবশালী মন্ত্রী ও তৃণমূলের এক পুর-নেতার সঙ্গেও দেখা গিয়েছে। অনেকেই বলছেন, নিতু প্রভাবশালীদের সঙ্গে সম্পর্কের জোরেই ক্লাবে প্রভাব বাড়িয়েছিলেন। কার্যকরী সমিতির সদস্য হলেও ক্লাবে তিনিই শেষ কথা। তদন্তকারীদের সূত্রের খবর, সিবিআই-কে দেওয়া চিঠিতে সুদীপ্তও নিতুকে ক্লাবের ‘ডি ফ্যাক্টো সেক্রেটারি’ বলেছিলেন।

গোয়েন্দাদের তলব পেয়ে বেলা এগারোটা নাগাদ কয়েক জন ঘনিষ্ঠকে নিয়ে সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে সিবিআই দফতরে হাজির হন নিতু। ঘণ্টাখানেক জিজ্ঞাসাবাদের পর সামান্য সময়ের জন্য এক বার বেরোনও তিনি। ওইটুকু বাদ দিলে টানা জেরা চালান গোয়েন্দারা। বিকেলে সিবিআই সরকারি ভাবে জানায়, সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার অভিযোগে দেবব্রত সরকারকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

গোয়েন্দা সূত্রের খবর, অনেক বিষয়ই এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন নিতু। “তাই শেষ পর্যন্ত দেবব্রতকে হেফাজতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তদন্তকারীরা,” মন্তব্য এক সিবিআই কর্তার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন