অন্ধকার থেকে আলোর পথে বাগনানে আর এক বেবি

অশিক্ষা থেকে শিক্ষা, নিকটজনের ‘অমানবিকতা’ থেকে অপরিচিতের আপন হয়ে ওঠা, বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়া— এ কাহিনিতে মিশে আছে সব।

Advertisement

সুব্রত জানা

বাগনান শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৯ ০৪:১০
Share:

শিউলি ভুঁইয়া

এ-ও এক আঁধার থেকে আলোয় উত্তরণ!

Advertisement

অশিক্ষা থেকে শিক্ষা, নিকটজনের ‘অমানবিকতা’ থেকে অপরিচিতের আপন হয়ে ওঠা, বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়া— এ কাহিনিতে মিশে আছে সব।

কাহিনির কেন্দ্রে বছর বাইশের এক গ্রাম্য যুবতী। নাম শিউলি ভুঁইয়া। পেশায় পরিচারিকা। আশৈশব অভাবে বাড়িতে তাঁর পড়াশোনা হয়নি। বাবার ‘অত্যাচার’ সহ্য করতে হয়েছে অনেক। দু’বছর আগে পরিবারের লোকেরা জোর করে তাঁর বিয়ে দিচ্ছিলেন। প্রতিবাদে তিনি বাড়ি ছেড়েছেন। বাগনানের আকুভাগ গ্রামের সেই যুবতীই যে বাড়িতে কাজ করেন, সেই বাড়িতে এতদিন পড়াশোনা করে বাগনান আনন্দ নিকেতনের রবীন্দ্র মুক্ত বিদ্যালয় থেকে আগামী শুক্রবার মাধ্যমিকে বসছেন।

Advertisement

এই লড়াই মনে পড়িয়ে দিচ্ছে ‘আলো আঁধারি’র বেবি হালদারকে। এক অসামান্য আত্মকাহিনির লেখিকা বেবিকেও তো এমন লড়াই করেই প্রতিষ্ঠিত হতে হয়েছে। এক দুঃস্বপ্নময় শৈশব কেটেছে তাঁরও। ১২ বছর বয়সে, ১৪ বছরের বড় এক পুরুষকে বিয়ে করতে হয়েছিল তাঁকে। স্বামীগৃহেও শান্তি পাননি। অল্প বয়সে তিন সন্তানের মা বেবি গুরগাঁও নিবাসী প্রবোধ কুমারের বাড়িতে পরিচারিকার কাজে যোগ দেওয়ার পরেই জীবনকে নতুন ভাবে দেখতে পান। প্রবোধের উৎসাহেই শেষমেশ নিছক পরিচারিকা থেকে স্বনামধন্য লেখিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ বেবির।

বড় চাকরি করে শিউলিও চান নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে। যাঁর কথা শুনে বেবি বলছেন, ‘‘আমার জীবনেও এই ঝড় গিয়েছে। আমি নিশ্চিত, শিউলি একদিন দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে।’’

বেবিকে ‘তৈরি’ করেছেন প্রবোধবাবু। শিউলি পাশে পেয়েছেন কাছের চন্দ্রভাগ গ্রামের অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, তাঁর স্ত্রী সুলতাদেবী এবং মেয়ে শতভিষাকে। ওই বাড়িতেই পরিচারিকার কাজ করেন শিউলি। অঞ্জনবাবু ডাক বিভাগের কর্মী। ২০১০ সালে ওই বাড়িতে প্রথম পরিচারিকার কাজ শুরু করেন শিউলির মা প্রতিমাদেবী। শিউলিরা তিন ভাইবোন। বাবা নির্মলবাবুর একটি ছোট মুদিখানা আছে। তাতে সংসার চলে না। ছোট থেকে নানা বাড়িতে মায়ের সঙ্গে পরিচারিকার কাজ করতে যেতেন শিউলি। অঞ্জনবাবুর বাড়িতে তিনি মায়ের সঙ্গে কাজ শুরু করেন ২০১১ থেকে। একদিন কাজে না-গেলে কপালে জুটত বাবা-মায়ের মার, অভিযোগ শিউলির।

কাজের ফাঁকে শিউলির পড়াশোনায় হাতেখড়ি অঞ্জনবাবুর স্ত্রী সুলতাদেবীর কাছে। ২০১২ সালে তাঁদের মেয়ে শতভিষা দিল্লি থেকে উচ্চশিক্ষা সেরে ফেরেন। তাঁর আব্দারেই শিউলি ওই বছর থেকে চট্টোপাধ্যায় বাড়িতে পাকাপাকি ভাবে থাকা শুরু করেন। মাঝেমধ্যে অবশ্য নিজের বাড়ি ফিরতেন। ততদিনে চট্টোপাধ্যায় বাড়ির কাজ ছেড়ে দিয়েছেন শিউলির মা।

শিউলির মাইনের টাকা ডাকঘরে জমান অঞ্জনবাবু। তাঁর বিয়ের সময় কাজে লাগবে বলে। বছর দুয়েক আগে শিউলির বিয়ের তোড়জোড় হয় তাঁর বাড়িতে। ওই টাকা দাবি করা হয়। আপত্তি জানিয়ে মারধর খেয়েও শিউলি ফিরে আসেন অঞ্জনবাবুর বাড়িতে। শিউলির বাবা সেখানে লোকজন নিয়ে হামলা চালান বলে অভিযোগ। রুখে দাঁড়ান শতভিষা। তারপরেই শিউলির পড়াশোনায় জোর বাড়ে।

সে দিনের কথা বলতে গিয়ে আজও কেঁপে ওঠেন শিউলি। তাঁর কথায়, ‘‘বাবা জোর করে বিয়ে দিচ্ছিল। সে দিন যদি জেঠু-জেঠিমা-দিদি পাশে না থাকতেন, আমার যে কী হত!’’ চট্টোপাধ্যায় পরিবারের চোখে এখন শিউলিকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন। অঞ্জনবাবু বলেন, ‘‘ওকে নিজের মেয়ের মতো ভাবি। ওর বাড়ির লোক অত্যাচার করত বলে নিজের কাছে রেখেছি। ওকে পড়াশোনা শিখিয়ে উচ্চশিক্ষিত করতে চাই।’’ আর শতভিষা বলেন, ‘‘শিউলিকে নিজের বোনের মতো ভালবাসি। ওর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হোক।’’ নির্মলবাবু অবশ্য দাবি করেন, ‘‘যা করেছি অভাবের জন্য। মেয়ে এখন আর আসে না। ও মাধ্যমিক দিচ্ছে। আমি খুশি।’’

চট্টোপাধ্যায় পরিবারের অবদানকে কুর্নিশ জানিয়েছেন বেবি। তাঁর কথায়, ‘‘অঞ্জনবাবুদের মতো মানুষ এখনও আছেন বলেই শিউলির মতো ফুল ঝরে যায়নি। শতভিষারও অনেক প্রশংসা প্রাপ্য। বাবা-মায়ের ভালবাসা ও শিউলির সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে। শিউলিকে বোনের মর্যাদা দিয়েছে।’’

মেয়ের মাধ্যমিকের সময় ছুটি নিয়েছিলেন অঞ্জনবাবু। শিউলির জন্যেও ইতিমধ্যে ছুটির আবেদন করেছেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন