SIR in West Bengal

ভুয়ো ভোটার ধরতে এআই-এর সাহায্য নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন! কৃত্রিম মেধার ছাঁকনিতে চিহ্নিত করা যাবে অনুপ্রবেশকারীদেরও

সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অনুমান করা হচ্ছে, ৪৩ লক্ষেরও বেশি নাম খসড়া ভোটার তালিকায় থাকবে না। তবে ঠিক কত নাম খসড়া তালিকা থেকে বাদ যেতে পারে, তা এখনই সঠিক অনুমান করা সম্ভব নয় বলেই মনে করছে কমিশন।

Advertisement

ভাস্কর মান্না

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২৫ ১০:১১
Share:

ভুয়ো ভোটার ধরবে এআই! — প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।

ভুয়ো ভোটার ধরতে এআই (কৃত্রিম মেধা) ব্যবহার করবে নির্বাচন কমিশন। এআই-এর ছাঁকনিতে ফেলে চিহ্নিত করা হবে ভুয়ো ভোটারদের। কমিশন সূত্রে এমনটাই জানা যাচ্ছে। ওই সূত্রের দাবি, এর মাধ্যমে অনুপ্রবেশকারীদেরও চিহ্নিত করা যাবে।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর)-এর কাজ নিয়ে এখনও কিছু ক্ষেত্রে অসন্তোষ রয়ে গিয়েছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির। ভোটার তালিকার ঝাড়াই-বাছাই চললেও অনুপ্রবেশকারী বা ভুয়ো ভোটারেরা রয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ বিরোধীদের (যদিও খসড়া তালিকা এখনও প্রকাশ হয়নি)। সত্যিই কি এমন কোনও সম্ভাবনা রয়েছে? কী ভাবে ধরা হবে ভুয়ো ভোটারদের? তার জন্যও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি রেখেছে কমিশন। কমিশন সূত্রের খবর, ভুয়ো ভোটারদের চিহ্নিত করতে এআই-এর সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। কমিশনের এক আধিকারিকের কথায়, “আমরা পুরো এআই ফর্মে কাজ করছি।” এর ব্যাখ্যাও দেন তিনি। তাঁর ব্যাখ্যায়, “এআই একটি সাধারণ কথা। কিন্তু গভীরে গিয়ে কাজটি করা হবে। মোদ্দা কথা হল, আমরা ডেটা এনালিসিস করব। ডেটা স্ক্যান করব। নিখুঁত স্ক্যান করা হবে। কারও কোনও তথ্যে গোলমাল থাকলে তা আমরা ধরতে পারব। এ ভাবে অনুপ্রবেশকারীও চিহ্নিত করা সম্ভব। কেউ যদি বাবার নাম অন্য দেন বা ২০০২ সালের তালিকার সঙ্গে অসঙ্গতি ধরা পড়ে, তাঁকে আমরা ডেকে পাঠাব।”

কমিশন সূত্রে খবর, এআই-এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ভোটারের নাম, ছবি, আধার নম্বর এবং মোবাইল নম্বর স্ক্যান করা হবে। তাঁর বাবা-মায়ের নামও স্ক্যান করা হবে এআই প্রযুক্তিতে। কমিশনের ব্যাখ্যা, নতুন করে দেশে যে এসআইআর হবে, সেই ঘোষণাই করা হয়েছিল গত জুলাই মাসে। বিহার ভোটের আগে। ফলে তার আগে এই সিদ্ধান্তের কথা সাধারণ জনতার জানার কথা ছিল না। ফলে ওই সময়ের পরে কোনও ভোটারের বাবা বা মায়ের নামে পরিবর্তন দেখা গেলে তা সন্দেহের তালিকায় থাকাই স্বাভাবিক।

Advertisement

সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অনুমান ৪৩ লক্ষের বেশি নাম খসড়া ভোটার তালিকায় থাকবে না। এর মধ্যে যেমন মৃত ভোটার রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন নিখোঁজ বা অন্যত্র চলে যাওয়া ভোটারও। এখনও পর্যন্ত প্রায় ৯৮ হাজার ভুয়ো ভোটারকে চিহ্নিত করা গিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। তবে কত জনের নাম খসড়া তালিকা থেকে বাদ পড়তে পারে, তা এখনই সঠিক অনুমান করা সম্ভব নয় বলে দাবি কমিশনের। কমিশনের ওই সূত্রের কথায়, প্রতিদিন এই সংক্রান্ত ডেটা পরিবর্তন হচ্ছে। তাই এখনই চূড়ান্ত ভাবে কিছু বলা ঠিক হবে না।

বিএলও-দের উপর চাপ কতটা?

সাম্প্রতিক সময়ে বিএলও-দের উপর কাজের চাপের বিস্তর অভিযোগ উঠছে। সোমবার পর্যন্ত রাজ্যের চার জেলায় অন্তত চার জন বিএলও-র মৃত্যু ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে। পূর্ব বর্ধমানে ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় এক বিএলও-র। মুর্শিদাবাদে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে এক জনের। জলপাইগুড়িতে এক বিএলও-র ঝুলন্ত দেহ মিলেছে। নদিয়ায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন এক বিএলও। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এসআইআর সংক্রান্ত কাজের চাপের অভিযোগ উঠেছে। যদিও অত্যাধিক চাপের তত্ত্ব মানতে নারাজ কমিশন। তাদের দাবি, বিএলও-দের উপর কাজের কিছুটা চাপ রয়েছে ঠিকই। তবে তা অত্যাধিক নয়।

কমিশন সূত্রের ব্যাখ্যা, বিএলও-রা বাড়়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করার ফলে তাঁদের উপর কাজের চাপ রয়েছে ঠিকই। তবে রাজ্যে এনুমারেশন ফর্ম বিলি এবং জমা নেওয়ার কাজ প্রায় ১০০ শতাংশই হয়ে গিয়েছে। কমিশনের দাবি, কাজের চাপ সত্যিই বেশি থাকলে এতটা অগ্রগতি হত না। কমিশনের ওই সূত্রের কথায়, কাজে চাপ একটু আছে নিশ্চয়ই। তবে খুব চাপ রয়েছে এমন বলা যাবে না। বস্তুত, অন্য বড় রাজ্যগুলির তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে এনুমারেশন ফর্ম ডিজ়িটাইজ়েশেনের কাজও তুলনামূলক ভাবে ভাল হয়েছে বলে দাবি কমিশনের।

বিএলও-দের মৃত্যুর ঘটনাগুলিকে ‘দুঃখজনক এবং অনভিপ্রেত’ বলে মনে কমিশন। তবে কমিশন এটিও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, রাজ্যে মোট ৮০,৬৮১ জন বিএলও রয়েছেন। কী কারণে বিএলও-দের মৃত্যু হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হবে বলেও জানিয়েছে কমিশন। ইতিমধ্যে পুলিশের কাছ থেকে রিপোর্ট চেয়েছে তারা। চাওয়া হয়েছে ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও। মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক (সিইও) দফতর সূত্রের আশ্বাস, “যে কারণেই মৃত্যু হোক, তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা চিন্তাভাবনা করেছি আমরা। কমিশনকে সেইমতোই জানানো হবে। তাঁরা কর্তব্যরত অবস্থায় মারা গিয়েছেন। তাই তাঁদের ক্ষতিপূরণের চিন্তাভাবনা আমরা করেছি।”

সময়সীমা কি আরও বাড়বে?

দ্বিতীয় দফায় পশ্চিমবঙ্গ-সহ ১২টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এসআইআর চলছে। এই কাজের জন্য যে সময়সীমা নির্দিষ্ট হয়েছিল, তা সম্প্রতি আরও বাড়িয়েছে কমিশন। প্রতিটি ধাপে এক সপ্তাহ করে অতিরিক্ত সময় দেওয়া হয়েছে। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে এনুমারেশন ফর্ম আপলোড করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বলা হয়েছিল। তা বাড়িয়ে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। তবে এই সময়সীমা আরও বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না বলেই মনে করছে কমিশন। নির্বাচন কমিশন সূত্রের দাবি, ইতিমধ্যে সময়সীমা সাত দিন বৃদ্ধি করা হয়েছে। কাজও অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। এ অবস্থায় নতুন করে আর সময়সীমা বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হবে না। তবে পাশাপাশিই জানা গিয়েছে, এখনই কমিশন এ বিষয়ে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি।

এগিয়ে বাংলা

এসআইআর-এর কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে রাজ্যের সাধারণ জনতার মনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষ কী ভাবে ইনুমারেশন ফর্ম পূরণ করবেন, তা নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। সোমবার পর্যন্ত রাজ্যে ‘এসআইআর আতঙ্কে’ অন্তত জনের ৩০ মৃত্যুর খবর মিলেছে। তবে কমিশনের বক্তব্য, অন্য বড় রাজ্যগুলির তুলনায় বাংলায় কাজ ভাল হচ্ছে। এমনকি, অন্য বড় রাজ্যগুলির কাছে পশ্চিমবঙ্গের এসআইআর-চিত্রকে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে। শহরাঞ্চলের তুলনায় বাংলার গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষের মধ্যে এসআইআর বেশি সাড়া পেয়েছে বলে দাবি কমিশন সূত্রের।

কমিশনের শুনানিতে নজরদারি

বিরোধী শিবির, বিশেষত বিজেপির তরফে বার বার অভিযোগ তোলা হচ্ছে, বিএলও-দের একাংশকে ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিল করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সোমবার সিইও দফতরে গিয়েও এই অভিযোগ জানিয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তবে কমিশন সূত্রের দাবি, বিভিন্ন অভিযোগ আসতেই পারে। কিন্তু নির্দিষ্ট ভাবে কোনও অভিযোগ না-এলে কমিশন কোনও পদক্ষেপ করতে পারে না। নির্দিষ্ট ভাবে কোনও অভিযোগ পেলে তা অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। একই সঙ্গে বিএলও এবং ইআরও-দেরও সতর্ক করে দিয়েছে কমিশন। কমিশন সূত্রের বক্তব্য, বিএলও বা ইআরও-রা কোথাও কোনও ‘ভুল এন্ট্রি’ করে থাকলে এক সপ্তাহের বর্ধিত সময়সীমার মধ্যে তা শুধরে নেওয়াই শ্রেয়।

পরিবর্তিত সময়সীমা অনুযায়ী আগামী ১৬ ডিসেম্বর খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ হবে। তার পরে সেই তালিকা সংক্রান্ত যাবতীয় অভিযোগ, আপত্তি কমিশনে জানানো যাবে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। খসড়া তালিকার সমস্ত আপত্তি, অভিযোগ এবং দাবি খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করা, বিতর্কের নিষ্পত্তি করা, প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট ভোটারকে শুনানিতে (হিয়ারিং) ডাকা এবং আলোচনার সাপেক্ষে সন্দেহ দূর করার কাজ ইআরও-রা করবেন ১৬ ডিসেম্বর থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এসআইআর-এর কাজে বিধানসভা স্তরে ইআরও-রাই হলেন সর্বোচ্চ দায়িত্বপ্রাপ্ত। রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভা কেন্দ্রের জন্য ২৯৪ জন ইআরও নিযুক্ত করেছে কমিশন। শুনানি করবেন তাঁরাই। কমিশন সূত্রের দাবি, শুনানির সময়ে ইআরও-দের তরফে কোনও ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভুল হচ্ছে কি না, তা-র উপরেও নজরদারি চালানো হবে। পুরো শুনানি প্রক্রিয়া সিসি ক্যামেরায় রেকর্ড করা হবে। আবেদনকারীকে কী কী প্রশ্ন করা হচ্ছে, তাঁর কাছ থেকে কী কী নথি দেখা হচ্ছে— সব কিছুর উপরেই নজর থাকবে কমিশনের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement