বকেয়া বিলের পাহাড়

জঙ্গলমহলকে আলো জুগিয়ে আঁধারে বণ্টন

প্রদীপের নীচেই অন্ধকার! সন্ধে হলে আদিবাসী গ্রামের ঘরে ঘরে বিজলি বাতি জ্বলে। অন্য দিকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে সরকারের ক্ষতির বহর।

Advertisement

পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায় ও কিংশুক গুপ্ত

কলকাতা ও ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:৪৭
Share:

প্রদীপের নীচেই অন্ধকার! সন্ধে হলে আদিবাসী গ্রামের ঘরে ঘরে বিজলি বাতি জ্বলে। অন্য দিকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে সরকারের ক্ষতির বহর।

Advertisement

জঙ্গলমহলে রোশনাই এনে এ ভাবেই লোকসানের কড়ি গুনছে রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা। তাদের হিসেবে, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ছড়িয়ে থাকা এই অঞ্চলে অনাদায়ী বিদ্যুৎ বিলের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে নয় নয় করে ৭৫ কোটি টাকা। সরকার অবশ্য এখনই কঠোর হতে নারাজ। মানুষকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে দফায় দফায় টাকা আদায়ের ব্যাপারে তারা আশাবাদী।

মাওবাদী তৎপরতার সময়ে এ তল্লাটের গ্রামে-গঞ্জে মিটার রিডিং নিতে যাওয়াটা ঝুঁকির ছিল। বিদ্যুৎকর্মীরা যতটা পারতেন, এড়িয়ে চলতেন। বণ্টন সংস্থার অফিসগুলোও নিয়মিত খোলা রাখা সম্ভব হতো না। উপরন্তু তুঙ্গে ছিল ‘ট্যাক্স’ বর্জনের মাওবাদী প্রচার। স্বভাবতই বিল আদায় ধাক্কা খাচ্ছিল। রাজ্যে পালাবদলের পরে জঙ্গলমহলে মাওবাদী প্রভাব প্রায় বিলীন হয়ে গেলেও ছবিটা কিন্তু বদলায়নি।

Advertisement

কেন?

কর্তারা জানাচ্ছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় জঙ্গলমহলের পরিকাঠামো উন্নয়নে বিলক্ষণ জোর পড়েছে। যার অঙ্গ ‘সবার ঘরে আলো’ প্রকল্প। এর দৌলতে বিপিএল পরিবারের নিষ্প্রদীপ বাড়িতেও বিদ্যুৎ পৌঁছে গিয়েছে।
বণ্টন কোম্পানির হিসেবে, তাদের ঝাড়গ্রাম ডিভিশনের ছ’টি গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্রের (ঝাড়গ্রাম, মানিকপাড়া, জামবনি, গোপীবল্লভপুর, বিনপুর ও বেলপাহাড়ি) আওতায় গৃহস্থ-গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ৬৮ হাজার। এর মধ্যে বিপিএল গ্রাহকই প্রায় ৭০ হাজার।

কিন্তু সমস্যা তৈরি হয়েছে গ্রাহকেরা বিল না-মেটানোয়। সংশ্লিষ্ট ছ’টি গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্র এলাকায় বকেয়া বিলের অঙ্ক ৪২ লক্ষ টাকা ছুঁইছুঁই। বিপিএল গ্রাহকদের
কাছে পাওনা সাড়ে ১৮ কোটি। এর বাইরেও জঙ্গলমহলের বহু গ্রামে বিল আদায়ের হাল বেহাল। গ্রামে-গ্রামে পঞ্চায়েত অফিসে ক্যাম্প করেও বিশেষ সুরাহা হয়নি।

বিজলিবাতি জ্বালিয়েও বিল দিচ্ছেন না কেন?

বেলপাহাড়ির লুলকি শবর, ঝাড়গ্রামের অঞ্জনা মাহাতো বা রামগড়ের বারি মুর্মুদের বক্তব্য: দিন-আনি-দিন-খাই সংসারে রোজ তিন-চার টাকা করে দেওয়া যায়। এক সঙ্গে অত টাকা দেওয়া অসম্ভব। ঝাড়গ্রামের পুকুরিয়া গ্রামের প্রৌঢ়া বিমলা মাহাতো এক ধাপ এগিয়ে বলেন, “দিদি (মুখ্যমন্ত্রী) এত কিছু দিচ্ছেন! বিনি পয়সায় কারেন্টটা তো দিতে পারেন!’’ রাজ্যের এক বিদ্যুৎকর্তার পর্যবেক্ষণ, ‘‘তিন মাসের বিল এক সঙ্গে যাচ্ছে। গরিব পরিবারের কাছে অঙ্কটা স্বাভাবিক ভাবেই বড় ঠেকছে। বিষয়টা ভেবে দেখার মতো।’’

তবে সামর্থ্য রয়েছে, এমন বহু পরিবারও বিল মেটাচ্ছে না বলে দফতরের অন্দরের অভিযোগ। ‘‘কিস্তিতে টাকা মেটানোর সুযোগ দিলেও অনেকে এগিয়ে আসছে না। পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে।’’— আক্ষেপ এক কর্তার। তা হলে লাইন কেটে দিচ্ছেন না কেন?

দফতরের একাংশের ব্যাখ্যা: জঙ্গলমহল সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহ। তাই ওখানে কড়া দাওয়াই প্রয়োগ সম্ভব নয়। তা ছাড়া লাইন কাটলে আদিবাসীদের মনে ক্ষোভ জমতে পারে। যার ফায়দা তুলতে পারে মাওবাদীরা। রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, জবরদস্তি কিছু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। আমরা চাইছি মানুষকে বুঝিয়ে, খেপে খেপে টাকা আদায় করতে। যাদের ক্ষমতা রয়েছে, তাদের কাছে প্রথমে যাচ্ছি।’’

মন্ত্রী সম্প্রতি পশ্চিম মেদিনীপুর সফরে গিয়ে জেলা প্রশাসন ও বিদ্যুৎ-কর্তাদের সঙ্গে এ প্রসঙ্গে আলোচনাও করেছেন। জনপ্রতিনিধিদের পরামর্শ দিয়েছেন বিল মেটানোর জন্য প্রচার চালাতে। তাতে কতটা কাজ হয়, এখন সেটাই দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন