তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
প্রয়াত হলেন বিশিষ্ট চিত্রসাংবাদিক তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিবার সূত্রে খবর, বুধবার সকাল সাড়ে ৭টায় মৃত্যু হয় চিত্রগ্রাহকের। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮। তারাপদের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) তিনি লেখেন, ‘‘আমাদের সময়ের বিখ্যাত চিত্রসাংবাদিক তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে গভীর ভাবে মর্মাহত। আমি তারাপদদাকে ভাল করে চিনতাম। ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর ছবি এবং কভারেজ খুব পছন্দ করতাম। তাঁর প্রতিটি ছবি যেন দৃশ্যকল্প তৈরি করত।’’
তারাপদের ছবি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে কী ভাবে জড়িয়ে রয়েছে, তা-ও জানান মুখ্যমন্ত্রী। মমতার স্মৃতিচারণা, বিরোধী নেত্রী থাকার সময় দক্ষিণ কলকাতার হাজরা মোড়ে তাঁর উপর সিপিএম বাহিনীর হামলার ঘটনার ছবি চলন্ত বাইক থেকে তুলেছিলেন তারাপদ। মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, ‘‘তারাপদদাকে মনে রাখার আরও একটি বিশেষ কারণ, তিনিই একমাত্র চিত্রগ্রাহক, যিনি দক্ষিণ কলকাতার হাজরা মোড়ে আমার উপর সিপিএমের গুন্ডাদের অত্যাচারের ছবি তুলেছিলেন। সেই সময় আমি বিরোধী দলনেত্রী। তারাপদদার পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও ভক্তদের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা।’’
১৯৪৬ সালে কলকাতায় জন্ম তারাপদের। ছোট থেকেই ক্যামেরা বিশেষ প্রিয় ছিল তাঁর। পরে ছবি তোলাকেই পেশা হিসাবে বেছে নেন। চিত্রসাংবাদিকতার পাশাপাশি আলোকচিত্রী হিসাবেও খ্যাতি অর্জন করেন তারাপদ। ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ব্যক্তিগত চিত্রগ্রাহক। ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে খবর, খুব কম সংখ্যক মানুষ ছিলেন, যাঁদের সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে অবাধ যাওয়া-আসা ছিল। তারাপদ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সেই সময় তাঁর তোলা সত্যজিৎ এবং অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের একটি ছবি ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। তারাপদ ‘উল্টোরথ’ নামক সিনেমা সংক্রান্ত একটি পত্রিকায় কাজ করতেন। সেই পত্রিকায় তারাপদের তোলা তৎকালীন বহু অভিনেতা-অভিনেত্রীর ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সূত্রে তাঁদের বাড়ির অন্দরমহলেও যাতায়াত তৈরি হয়েছিল চিত্রগ্রাহকের।
তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি। আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
তারাপদের গুণগ্রাহী এক চিত্রসাংবাদিক জানান, ছবি তুলতে গিয়ে যে কোনও ধরনের ঝুঁকি নিতে পারতেন তিনি। জোড়াসাঁকোয় পণ্ডিত রবিশঙ্করের ছবি তুলতে গিয়ে পুলিশের তাড়া খেয়েছিলেন! তার পরেও বড় বড় থামের ফাঁক দিয়ে যে সব ছবি তুলেছিলেন, তাতে মুগ্ধ হতে হয়। বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী যখন লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথযাত্রা আটকে দিয়েছিলেন, সেই ‘আটকে’ রাখার ছবি তুলে এনেছিলেন তারাপদ, যা আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায় বড় করে ছাপাও হয়েছিল। চিত্রসাংবাদিকের কথায়, ‘‘তারাপদদার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল, খুব তাড়াতাড়ি ছবি তুলতে পারতেন। যে কোনও পরিস্থিতিতে দ্রুত লেন্স বদলে ছবি তুলে নিতে পারতেন তিনি।’’
তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি। আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
ছবি তোলার পাশাপাশি লেখালিখিও করেছেন তারাপদ। তাঁর লেখা ‘মুহূর্তরা মুহূর্তের কাছে ঋণী’ বইতে সত্যজিৎ রায়ের কাজ এবং বিশেষ মুহূর্তে তোলা ১৫৬টি ছবি এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা রয়েছে। এই বইতে তারাপদ জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তিনি ঢাকায় গিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি ধানমন্ডিতে নজরবন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সঙ্গে প্রথম দেখা করেছিলেন। মুজিবুর যে দিন বাড়ি ফিরেছিলেন, সেই দিন তাঁর বাড়িতে চিত্রগ্রাহক হিসাবে একমাত্র তারাপদই উপস্থিত ছিলেন।