সুপার স্পেশ্যালিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব, বন্ধের মুখে ইএসআইয়ের জরুরি প্রকল্প

কোন সুপার স্পেশ্যালিটি চিকিৎসায় কেন্দ্র টাকা দেবে আর কোনটায় দেবে না, মূল দ্বন্দ্বটা সেই জায়গায়। ইএসআই স্বাস্থ্যপ্রকল্পে টাকা দেওয়া নিয়ে যুযুধান দুই পক্ষ যথারীতি কেন্দ্র ও রাজ্য। এবং এই লড়াইয়ের জেরে অনিশ্চিত হতে বসেছে প্রায় ৯০০ জন গুরুতর অসুস্থ রোগীর চিকিৎসার ভবিষ্যৎ!

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৬ ১৭:৪৬
Share:

কোন সুপার স্পেশ্যালিটি চিকিৎসায় কেন্দ্র টাকা দেবে আর কোনটায় দেবে না, মূল দ্বন্দ্বটা সেই জায়গায়।

Advertisement

ইএসআই স্বাস্থ্যপ্রকল্পে টাকা দেওয়া নিয়ে যুযুধান দুই পক্ষ যথারীতি কেন্দ্র ও রাজ্য। এবং এই লড়াইয়ের জেরে অনিশ্চিত হতে বসেছে প্রায় ৯০০ জন গুরুতর অসুস্থ রোগীর চিকিৎসার ভবিষ্যৎ!

ইএসআই কর্পোরেশনের নিয়মে, তাদের স্বাস্থ্য প্রকল্পে সুপার স্পেশ্যালিটি চিকিৎসা (যেমন ইউরোলজি, নেফ্রোলজি, নিউরোসার্জারি, কার্ডিও ভাস্কুলার সার্জারি ইত্যাদি) পরিষেবার টাকা কেন্দ্রের দেওয়ার কথা। ডায়ালিসিস ও রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্ট নেফ্রোলজির মধ্যে, অর্থাৎ সুপার স্পেশ্যালিটি চিকিৎসার মধ্যেই পড়ে। তা সত্ত্বেও মানিকতলা ইএসআই হাসপাতালের ডায়ালিসিস এবং রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্ট পরিষেবার কোনও খরচ কেন্দ্র দিচ্ছে না বলে অভিযোগ।

Advertisement

রাজ্যের ১৩টি ইএসআই হাসপাতালের মধ্যে একমাত্র মানিকতলা হাসপাতালেই ডায়ালিসিস ও রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয় এবং ওই রোগীরা তাঁদের ওষুধ পান। এখানে ৭টি ডায়ালিসিস মেশিন চলে। এই চিকিৎসার পুরো খরচটাই এখন দিতে হচ্ছে রাজ্যকে আর তা করতে গিয়ে টাকা জোগাতে কার্যত নাস্তানাবুদ হতে হচ্ছে। যে সব সংস্থা ওই হাসপাতালে রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্ট ও ডায়ালিসিসের চিকিৎসাসামগ্রী এবং ওষুধ সরবরাহ করে তাঁদের কোটি কোটি টাকা বাকি পড়েছে গত দু’বছর ধরে।

টাকা না পেয়ে এমনিতেই গত কয়েক মাস ধরে রোগীর চারটি ওষুধ লাগলে সরবরাহকারী সংস্থা একটি সরবরাহ করছিল। বকেয়া না মেটালে আগামী মাস থেকে সেটুকুও বন্ধ করতে তারা বাধ্য হবে বলে মানিকতলা কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছে। ফলে প্রায় ৯০০ অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা প্রক্রিয়ার উপরেই প্রশ্নচিহ্ন বসেছে। বারাসতের যে সংস্থা এখানে মূলত ডায়ালিসিস ও রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্ট্রের রোগীদের ওষুধ দেয় তাদের এক মুখপাত্র বলেন, ‘‘চার কোটি টাকা বাকি পড়েছে। আমরাও তো ব্যবসা করি, আর চালাতে পারছি না।’’ এক সংস্থার দেড় কোটি টাকা, এক সংস্থার ১০ লক্ষ টাকা ও আর এক সংস্থার আড়াই কোটি টাকা বাকি রয়েছে।

ডায়ালিসিস ও রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্টের সামগ্রী ও ওষুধের টাকার জোগান দিতে রাজ্যের ভাঁড়ারে এতটাই টান পড়েছে যে, হাসপাতালগুলিতে সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক, বমির ওষুধ, প্যারাসিটামলও কেনা যাচ্ছে না। চুক্তিবদ্ধ বেসরকারি হাসপাতালগুলিরও কয়েক লক্ষ টাকা বকেয়া রয়ে গিয়েছে।

কিন্তু সুপার স্পেশ্যালিটি চিকিৎসা পরিষেবার টাকা যখন কেন্দ্রের দেওয়ার কথা তখন মানিকতলা ইএসআইয়ের ক্ষেত্রে তারা তা দিচ্ছে না কেন? ইএসআই কর্পোরেশনের পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক সিনিয়ার মেডিক্যাল কমিশনার ব্যাখ্যা দেন, কর্পোরেশনের নিয়মে ইএসআই হাসপাতালগুলি সুপার স্পেশ্যালিটি চিকিৎসা পরিষেবা চালাতে পারেন একমাত্র তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ কোনও বেসরকারি হাসপাতাল-মারফৎ। তাতে যা খরচ হবে সেই টাকা কর্পোরেশন সরাসরি ওই চুক্তিবদ্ধ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু মানিকতলায় ডায়ালিসিস ও রেনাল ট্রান্সপ্ল্যান্টের ক্ষেত্রে তা হয়নি।

তিনি জানান, চুক্তিবদ্ধ কোনও হাসপাতালের বদলে মানিকতলা ইএসআই নিজেদের হাসপাতালেই ওই পরিষেবা শুরু করেছে। ওই কর্তার কথায়, ‘‘নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করলে মানিকতলা ভাল কাজই করছে। অনেক রোগীর এতে হয়তো সুবিধাই হচ্ছে। কিন্তু ইন-হাউজ সুপার স্পেশ্যালিটি চিকিৎসার জন্য কেন্দ্রের টাকা দেওয়ার নিয়ম নেই। আমরা নিরুপায়।’’ একই অবস্থা শিয়ালদহ ইএসআইয়েরও। রাজ্যের ইএসআই হাসপাতালগুলির মধ্যে একমাত্র এই হাসপাতালেই ইন-হাউজ কেমোথেরাপি-র ওষুধ দেওয়া হয়। বছরে প্রায় ৫০০ রোগী ওই ওষুধ নেন। এই ওষুধগুলি খুব দামি।

রাজ্যের ইএসআই কর্তাদের মতে, কেমোথেরাপি হল অঙ্কোলজি-র অন্তর্গত। অঙ্কোলজি সুপার স্পেশ্যালিটি বিষয় হওয়া সত্ত্বেও এই কেমোর টাকা কেন্দ্র দিচ্ছে না যেহেতু তা ইনহাউজ দেওয়া হচ্ছে। ফলে শুধু এর জন্যই রাজ্যের দু’বছরে ১২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এই টাকা মেটাতে গিয়ে হাসপাতালে অন্য ওষুধপত্র ও চিকিৎসা সামগ্রী কেনা যাচ্ছে না।

কেন্দ্র যদি টাকাই না দেবে তা হলে ডায়ালিসিস মেশিন বসানোর সময় বা কেমো চালুর সময় বাধা দেয়নি কেন? কেন্দ্রে ইএসআই কর্পোরেশনের এক কর্তার বক্তব্য, ‘‘রাজ্য নিয়ম না জেনে ওই পরিষেবা শুরু করছে সেটা আমরা বুঝব কী করে? আমরা ভেবেছি রাজ্য আলাদা করে টাকার ব্যবস্থা করতে পেরেছে বলেই ইন-হাউজ কিছু ইএসআই হাসপাতালে সুপার স্পেশ্যালিটি চিকিৎসা খুলছে।’’

যার জবাবে রাজ্যের ইএসআই ডিরেক্টর মৃগাঙ্কশেখর কর মন্তব্য করেন, ‘‘২০১২ সাল পর্যন্তও কেন্দ্র ইন-হাউজ সুপার স্পেশ্যালিটি চিকিৎসার খরচ দিত। তার পর ওদের কী সব অদ্ভুত নিয়ম পরিবর্তন হয়েছে।’’ তাঁর মতে, ‘‘একে তো কেন্দ্র প্রয়োজনের থেকে অনেক কম টাকা দেয়। তার পর একই সুপার স্পেশ্যালিটি চিকিৎসা ইন-হাউজে করলে কেন্দ্র টাকা দেবে না আর চুক্তিবদ্ধ হাসপাতাল হলে কেন্দ্র টাকা দেবে এটা তো হাস্যকর।’’

এই চাপানউতোরে অসংখ্য রোগীর চিকিৎসা বন্ধ হতে বসেছে দেখে গত ১৩ জানুয়ারি দিল্লিতে ইএসআই কর্পোরেশনে গিয়ে কর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন রাজ্যের ইএসআই ডিরেক্টর মৃগাঙ্কশেখর কর। কেন্দ্র জানিয়েছে, তারা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন