বোলতার মতো বিষ, ভয় নেই ট্যারান্টুলায়

কথায় কথায় ট্যারান্টুলা বেরোচ্ছে দিন কয়েক ধরে। লোমশ, একটু বড় ধরনের মাকড়সা মানেই কিন্তু ট্যারান্টুলা নয়। যদি ট্যারান্টুলা হয়ও আশঙ্কার কিছু নেই। আশ্বাস দিলেন সুমন প্রতিহার

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৮ ০১:০৫
Share:

এগরায় বনকর্মীদের হাতে উদ্ধার হওয়া রোমশ মাকড়শা। ট্যারান্টুলা (ইনসেটে)। নিজস্ব চিত্র

দক্ষিণ ইতালির সমুদ্রতীরের ছোট্ট একটি জনপদ। নাম ট্যারান্টো। লোকজনের বসবাস তেমন নয়। এই জনপদই হঠাৎ খবরের শিরোনামে। সময়টা ১৫৬০ সাল নাগাদ। খবর ছড়াল, লোকজনকে বিষাক্ত রোমশ মাকড়সা কামড়াচ্ছে। তাতে মৃত্যুও হচ্ছে। ওষুধ বলতে এক বিশেষ ধরনের নাচ। যাকে কামড়াবে তাকে প্রবল ভাবে নেচে যেতে হবে। যতক্ষণ না তার শরীরের সমস্ত বিষ ঘাম হয়ে বেরিয়ে যাবে ততক্ষণ নাচ চলবে। শেষে ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়বেন মাকড়সা কামড়ানো ব্যক্তিটি। ট্যারান্টো জনপদের নামানুসারে রোমশ মাকড়সার নাম হল ট্যারান্টুলা। পরে অবশ্য জানা গেল, যার কামড়ে এই আতঙ্ক সে আদপেই ট্যারান্টুলা নয়। তার থেকে অনেক ছোট এবং বিষাক্ত সেই মাকড়সার নাম ‘ব্ল্যাক উইডো’।

Advertisement

ভুলের সেই শুরু। সেই ধারা আজও বজায় রয়েছে। আজও তাই আপাত নিরীহ, প্রায় বিষহীন লোমশ মাকড়সাকে আমরা ট্যারান্টুলা নামকরণ করে ‘খুনি’ হিসেবে দেগে দিয়েছি। বেশ রঙিন, লোমশ এই মাকড়সা। তারপর বহু রোমশ মাকড়সাকে প্রায় এক প্রকার জোর করে ট্যারন্টুলা শ্রেণিভুক্ত করা হয়। আর ইতালির সেই বিষ ঝরানো নাচ আজ ট্যারান্টেলা নামে পরিচিত।

পৃথিবীতে প্রায় ৯০০ প্রজাতির ট্যারান্টুলা দেখতে পাওয়া যায়। তাদের বেশ কিছু ভারতেও পাওয়া যায়। দেশে বর্তমানে প্রায় ন’টি প্রজাতির ট্যারান্টুলা দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে পাওয়া যায় একটি মাত্র প্রজাতির ট্যারান্টুলা। এই প্রজাতি ‘বেঙ্গল অর্নামেন্টাল স্পাইডার’ নামে পরিচিত। এদেরই সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। আরেকটি আছে। নীলচে ধরনের। সেটি মূলত ঝাড়খণ্ড, অন্ধ্রপ্রদেশে মেলে। কখনও সখনও বাংলায় দেখা মেলে। সুতরাং চারিদিকে এত রোমশ মাকড়সা বেরিয়ে পড়ছে আর সকলে সবই ট্যারান্টুলা বলে মনে করছেন, সেটা বাস্তবে সম্ভব নয়। ট্যারান্টুলা বাইরে থেকে দেখেই বলে দেওয়াটা খুব একটা সম্ভব নয়। কামড়ের দাগ দেখে বোঝা যেতে পারে। তা-ও খালি চোখে সেই কাজটা বেশ অসম্ভব।

Advertisement

টাইগার স্পাইডার ভারতের সবচেয়ে বড় মাকড়সা। থেরাপোসিয়েডি পরিবার ভুক্ত প্রাণী ট্যারান্টুলা। আমাদের চারপাশে যে সমস্ত মাকড়সা দেখতে পাই, তাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এই মাকড়সা। পুরুষ ট্যারান্টুলা স্ত্রীদের থেকে আকারে ছোট হয়। এরা সাধারণত নিশাচর হয়। আমরা যেসব ট্যারান্টুলা দেখতে পাই তাদের বেশির ভাগই পুরুষ। কারণ রাতে পুরুষ ট্যারান্টুলা সক্রিয় হয়। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এখন হঠাৎ এত মাকড়সা বেরিয়ে আসছে কেন? এর উত্তর হল, এখন এদের প্রজননের সময়। পুরুষগুলো স্ত্রী মাকড়সা খুঁজে বেড়াচ্ছে। যেখানে থাকার কথা সেখানে না পেয়ে তারা হন্য হয়ে বিভিন্ন সম্ভাব্য স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ধরাও পড়ছে।

সচরাচর দেখতে পাওয়া মাকড়সার মতো এরা জাল বুনে শিকার করে না। এরা তাদের শিকারের জন্য অপেক্ষা করে। এবং সুবিধে মত দু’টো ছোট দাঁত দিয়ে বিষ শিকারের দেহে ঢেলে দেয়। বিষে শিকার ধীরে ধীরে অবশ হয়ে মারা যায়। এরা বিশেষ ধরনের উৎসেচক শিকারের দেহে ঢুকিয়ে দেয়। ওই উৎসেচক শিকারের দেহের প্রোটিন গলিয়ে দেয়। ট্যারান্টুলা তাদের মুখের নল দিয়ে খুব সহজেই তা চুষে নেয়। এদের পায়ে এবং উদরে লোম থাকে। যা আত্মরক্ষায় কাজে লাগে। কিছু বিশেষ প্রজাতির ট্যারন্টুলা শরীর থেকে লোম ছুড়তে পারে। সেগুলো শিকারের গায়ে লেগে যায়। শিকার অবশ হয়ে পড়ে। মনে রাখতে হবে, ট্যারান্টুলার বিষ খুব অল্প। একটা বোলতার কামড়ের সমান। এদের বিষ শুধু শিকার ধরার জন্য। মানুষের শরীরে এই বিষের প্রভাব খুব অল্প ও ক্ষণস্থায়ী। ট্যারান্টুলার রোমশ অংশ মানুষের চোখে ও ত্বকে লাগলে কিছু জ্বালা-যন্ত্রণা হতে পারে। তা খুবই ক্ষণস্থায়ী।

ট্যারান্টুলা প্রজাতির মাকড়সা প্রায় ৩০ বছর বাঁচে। যদিও পুরুষ মাকড়সার জীবনকাল মাত্র আট বছর। এরা শুকনো, ঝুরো মাটিতে বসবাস করতে পছন্দ করে। গাছেও দেখতে পাওয়া যায়। এরা তন্তু (সিল্ক) বুনতে পারে। ঘর তৈরি এবং জননের প্রয়োজনে এরা তন্তু তৈরি করে উদরের বুনন যন্ত্র দিয়ে। খাদ্য ছোট ছোট পোকা এবং অন্য প্রজাতির মাকড়সা। কিছু প্রজাতির ট্যারান্টুলা ছোট সরীসৃপ, ইঁদুর ও ছোট পাখি শিকার করতে পারে। ট্যারান্টুলা সাপের মতো খোলস ত্যাগ করে। স্ত্রী ট্যারান্টুলা প্রায় সারাজীবন খোলস ত্যাগ করে। কিন্তু পুরুষ ট্যারান্টুলা পরিণতি পাওয়া পর্যন্ত খোলস ত্যাগ করে।

প্রজননের সময় পুরুষ মাকড়সা তন্তু বুনে তার মধ্যে শুক্রাণু আটকে রাখে। এরপর পুরুষটি সেই শুক্রাণু তার মুখের বিশেষ অঙ্গে বয়ে বেড়ায়। বিভিন্ন গর্তে স্ত্রী মাকড়সার খোঁজ শুরু হয়। স্ত্রী মাকড়সাও ফেরোমেনের (হরমোন) সাহায্যে পুরুষকে আকর্ষণ করে। উপযুক্ত সাথী পেলে পুরুষটি মাথা নামিয়ে উদর অংশ উপরে তুলে স্ত্রী মাকড়সাকে আকৃষ্ট করতে থাকে। এবং সামনের দু’টি পা দিয়ে গর্তের সামনে শব্দ করতে থাকে। পুরুষের প্রদর্শনে প্রসন্ন হলে স্ত্রী গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। তখন পুরুষটি মুখে লেগে থাকা শুক্রাণুগুলো স্ত্রী মাকড়সার ডিম্বাণুর কাছে প্রবেশ করিয়ে দেয়। পরে নিষিক্ত ডিম নিয়ে স্ত্রী মাকড়সা কোকুন তৈরি করে। যা নিয়ে স্ত্রী মাকড়সা পরবর্তী সময়গুলো কাটাতে পারে। প্রজননের ঠিক পরে পরেই স্ত্রী মাকড়সা পুরুষ মাকড়সাকে খেয়ে ফেলে। অনুকূল পরিবেশ না পেলে কোকুন থেকে পূর্ণাঙ্গ মাকড়সায় পরিণত হতে প্রায় ৮-১০ বছর সময় লাগতে পারে। কোকুন থেকে একবারেই ৫০০-১০০০ ট্যারান্টুলার জন্ম নেয়।

ট্যারান্টুলা আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মানুষের প্রিয় পোষ্য। কানাডায় এক বিশেষ প্রজাতির ট্যারান্টুলা শুধুমাত্র মানুষের পোষ্য হওয়ার জন্যই বিপন্ন। আন্তর্জাতিক আইন করে এই মাকড়সার বাণিজ্য বন্ধ করা হয়েছে। আমরা ট্যারান্টুলা আতঙ্কে অস্থির। কিন্তু এই মাকড়সা একটি বিশেষ প্রজাতির বোলতার কাছে অসহায়। এই বোলতা জীবিত ট্যারান্টুলাকে কামড়ায়। বিষ ঢেলে তাদের অবশ করে সেই জায়গায় ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার পরে অবশ মৃতপ্রায় ট্যারান্টুলাকে টেনে নিয়ে যায় মাকড়সার নিজের গর্তে। ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। সেই সদ্যোজাতেরা জীবিত অথচ অবশ ট্যারান্টুলার রক্ত, মাংস খেয়ে বড় হতে থাকে। আমাদের আতঙ্কের কারণ বিষধর লোমশ ট্যারান্টুলা ধীরে ধীরে মারা যায়।

লেখক প্রাণিবিদ্যার গবেষক এবং অধ্যাপক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন