তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পরে এ বার পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম। সিঙ্গুর মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় ঘোষণার আগে ফের টাটাদের উদ্দেশে বার্তা গেল শাসক দলের তরফে!
‘সিঙ্গুর দিবসে’র অনুষ্ঠানে গিয়ে তিন দিন আগেই পার্থবাবু বলেছিলেন, আদালতের রায়ের আগেই জনতার মন বুঝে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে সিঙ্গুরের জমি ফেরত দিন টাটা কর্তৃপক্ষ। পরে অবশ্য পার্থবাবু টাটাদের সঙ্গে আদালতের বাইরে সমঝোতার বার্তার কথা অস্বীকার করেন। ফিরহাদ অবশ্য জমি ফেরানোর প্রসঙ্গে যাননি। তিনি সরাসরি টাটা-তৃণমূল সম্পর্ক নিয়ে জনমানসে প্রচলিত ‘ধারণা’ ভাঙতে চেয়েছেন! যা থেকে ফের প্রশ্ন উঠেছে, সর্বোচ্চ আদালতের রায় বেরোনোর আগেই কি সিঙ্গুরে অচলাবস্থা সৃষ্টিতে দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছে তৃণমূল? সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকেরা অপেক্ষায় আছেন প্রায় ৮ বছর। তার মধ্যে তৃণমূল জমানার সাড়ে তিন বছরেই জমি ফেরত পাওয়ার আশা বেশি ছিল তাঁদের। ক্ষুব্ধ ও ক্লান্ত সিঙ্গুরের সেই বাসিন্দাদের আশাপূরণের আশা নেই বুঝেই শাসক দলের একের পর নেতা-মন্ত্রী এখন টাটাদের উদ্দেশে বার্তা দিচ্ছেন কি না, প্রশ্ন উঠছে নানা মহলে।
তারাতলায় মারুতি-সুজুকির অন্যতম ডিলারের নতুন পরিষেবা কেন্দ্র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রবিবার এসেছিলেন মন্ত্রী ফিরহাদ। ছিলেন মারুতি-সুজুকি ইন্ডিয়ার ম্যানেজিং ডিরেক্টর তথা সিইও কেনিচি আয়ুকায়া-সহ সংস্থার পদস্থ কর্তারাও। সেখানে নিজেই টাটার ন্যানো প্রকল্পের প্রসঙ্গ টেনে ফিরহাদ বলেন, “একটা ধারণা রয়েছে যে, আমরা টাটাদের ন্যানো প্রকল্পের বিরোধী। আমরা ন্যানোর বিরোধী নই। আমরা শিল্পপতিরও বিরোধী নই। তখনকার রাজ্য সরকারের আচরণের বিরোধিতা করেছিলাম। তারা চেয়েছিল পুলিশ দিয়ে জোর করে কৃষকের কাছ থাকে জমি কাড়তে।” এখানেই থামেননি পুরমন্ত্রী। তাঁর আরও যুক্তি, “ওটা (সিঙ্গুর) আমাদের দলের আন্দোলন ছিল না! পুলিশের জমি জবরদখলের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ, কৃষকেরা আন্দোলন করেছিলেন। আমরাও সরকারের ভূমিকার প্রতিবাদ করেছিলাম।”
তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, ফিরহাদ যা বলেছেন, সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় থেকে তা-ই বলে এসেছেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনিও বোঝানোর চেষ্টা করে গিয়েছেন, তাঁরা টাটাদের বিরুদ্ধে নন। তাঁরা জোর করে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে। যদিও শিল্প ও বাণিজ্য মহলের ব্যাখ্যা, মুখে যা-ই দাবি করুন, তৃণমূল নেতারাও জানেন সিঙ্গুর-পর্ব ও তার পরে ঘটনাপ্রবাহের জেরে শিল্পপতিদের কাছে সম্পূর্ণ নেতিবাচক বার্তা গিয়েছে মমতার দল সম্পর্কে। রাজ্যে এখন শিল্পের আকাল। তার মধ্যে সিঙ্গুর মামলার রায়ও আসন্ন। এমতাবস্থায় চাপের মুখে পড়ে ফিরহাদেরা এখন শিল্প মহলের আস্থা ফিরে পেতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন, এ ভাবেই বিষয়টিকে দেখছেন শিল্প ও বাণিজ্য জগতের কর্তারা।
অল্প দিনের ব্যবধানে ফিরহাদের ‘ভোলবদল’ দেখলেই রাজ্য সরকার তথা শাসক দলের মরিয়া চেষ্টা আরও স্পষ্ট হয়! সম্প্রতি কলকাতায় এসে রাজ্যে শিল্পায়ন নিয়ে নিজের ধারণার কথা বলেছিলেন রতন টাটা। রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র তখন কটাক্ষ করেছিলেন টাটার ‘মতিভ্রম’ হয়েছে! সঙ্গত করেছিলেন ফিরহাদও। টাটার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে দাবি করে পুরমন্ত্রী তখন বলেছিলেন, “কিছু লোক আছেন, যাঁরা ‘কমিটেড’, বাংলার ভাল চায় না। টাটার সার্টিফিকেটের দরকার নেই। রতন টাটা যেন দেবপুত্র! মাঝে মাঝে এসে দেববাণী দিয়ে চলে যাবেন! তার চেয়ে সামনে এসে রাজনীতি করুন!” টাটা সংস্থার চেয়ারম্যানশিপ হারিয়ে রতন টাটার মাথা খারাপ হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি। যদিও ঘটনা হল, ৭৫ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার পরে টাটা চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দিলেও টাটা গোষ্ঠী তাঁকে ইমেরিটাস চেয়ারম্যান পদে বসায়। ফিরহাদের ওই মন্তব্যের সঙ্গে এ দিনের কথা পাশাপাশি রাখলেই মনোভাবে পরিবর্তনের চেষ্টা স্পষ্ট!
পুরমন্ত্রী অবশ্য এ দিনও বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, তাঁরা শিল্পায়নে সচেষ্ট। ফিরহাদের কথায়, “শহরে নতুন কিছু হলে খুশি হই।
কারও কারও হয়তো ভিন্ন মত রয়েছে। তবুও পরিসংখ্যানই বলছে, দেশের চেয়ে এ রাজ্যে ব্যবসা বাড়ছে বেশি হারে।” তাঁর দাবি, অনেক বাধা থাকলেও এখন এ রাজ্যে ব্যবসা করা অনেক সহজ। তিনি বলেন, “কারণ গোটা বিশ্বই এখন ‘পুবে তাকাও’ নীতির উপর জোর দিচ্ছে। সেখানে কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম।” পুরমন্ত্রীর আরও বক্তব্য, “আমরা শিল্পের বিরোধী নই। আমরা বিশ্বাস করি, শিল্প বা ব্যবসার যত বৃদ্ধি হবে, রাজ্যেরও বৃদ্ধি ঘটবে। আপনাদের আয় বাড়লে, রাজ্যেরও কর বাবদ আয় বাড়বে।” তাই সিঙ্গুর না হলেও মারুতি-সুজুকির কর্তাদের প্রতি ফিরহাদের আর্জি, “এখানে একটা কারখানা গড়ুন। সরকার সব সাহায্য করবে।” স্মিত হাসি ছাড়া আর কোনও প্রতিক্রিয়া অবশ্য জানাননি দেশের বৃহত্তম গাড়ি সংস্থাটির কর্তারা!