স্বামীহারা। বেআইনি হুকিংয়ের প্রতিবাদ করে খুন হওয়া নজরুলের স্ত্রী সালমা বিবি। —নিজস্ব চিত্র
পেশায় জরি ব্যবসায়ী। আর নেশা প্রতিবাদ করা। সেটা জুয়া-মদের আসরের বিরুদ্ধে হোক, ইভটিজিং হোক বা বিদ্যুৎ চুরি। বরাবরই রুখে দাঁড়াতেন তিনি। বছর দুয়েক আগে বাড়ির পাশে জুয়া-মদের আসরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোয় দুষ্কৃতীরা শুধু বাড়িতে ভাঙচুর চালায়নি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকেও নিগ্রহ করেছিল। তার জেরে ওই মহিলার গর্ভপাতও হয়ে যায় বলে অভিযোগ। কিন্তু তার পরেও চুপ করে থাকার কথা ভাবেননি তিনি। শুক্রবার রাতে সেই নিরন্তর প্রতিবাদেরই চরম মাসুল দিতে হল নজরুল ইসলামকে (৪৭), নিজের প্রাণ দিয়ে।
এ বারের প্রতিবাদ ছিল বেআইনি হুকিংয়ের বিরুদ্ধে। নজরুল সিইএসসি-র লোকজনকে শুধু খবরই দেননি, শুক্রবার দুপুরে বেআইনি সংযোগ কাটার সময়ে তিনি সশরীর হাজির ছিলেন। সেই ‘অপরাধে’ শুক্রবার রাতেই মেটিয়াবুরুজের লিচুবাগান বস্তির বাসিন্দা নজরুলকে বাঁশ ও রড দিয়ে পিটিয়ে এবং বড় পাথর দিয়ে থেঁতলে হত্যা করল দুষ্কৃতীরা।
রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বিদ্যুৎ চুরি রুখতে গিয়ে কাউকে এ ভাবে খুন হতে হলে এর পরে বিদ্যুৎ চুরি ঠেকাতে কে-ই বা এগিয়ে আসবে?’’
পুলিশ ওই ঘটনায় খুনের মামলা রুজু করেছে। শনিবার রাত পর্যন্ত এক জন ধরা পড়েছে। ধৃত শেখ আলম আবার ১৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল সভাপতি শেখ উমরের ভাই।
মেটিয়াবুরুজের তৃণমূল বিধায়ক আবদুল খালেক মোল্লার অবশ্য দাবি, ‘‘উমরের ভাই হলেও আলমের সঙ্গে দলের সম্পর্ক নেই। দলের কেউ এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়।’’
বস্তির এক-চিলতে ঘরে বসে নজরুলের স্ত্রী সালমা বিবি এ দিন বলেন, ‘‘আমার স্বামীকে যারা খুন করেছে, তারা এলাকার দাগী দুষ্কৃতী। বিভিন্ন অসামাজিক কাজে জড়িত। বরাবরই ওদের বিরুদ্ধে আমার স্বামী প্রতিবাদ করেছে। পুলিশ ওদের বিরুদ্ধে আগে ব্যবস্থা নিলে আজ আমাকে অকাল বিধবা হতে হতো না।’’ নজরুল ও সালমার দশ ও ছ’বছরের দু’টি মেয়ে আছে। তারা স্কুলে পড়ে।
বিধায়ক খালেক মোল্লার বক্তব্য, ‘‘নিহত ব্যক্তির স্ত্রী অযৌক্তিক কিছু বলছেন না।’’
পড়শিরা জানাচ্ছেন, প্রতিবাদী নজরুল বারবার দুষ্কৃতীদের হুমকি ও আক্রমণের মুখে পড়লেও সালমা কখনও চাননি, তাঁর স্বামী চুপ করে থাকুন। সালমাও জরির ব্যবসায় যুক্ত। বছর পঁয়ত্রিশের ওই তরুণীর অভিযোগ, বছর দুয়েক আগে মদ ও জুয়ার ঠেক চালানো দুষ্কৃতীরা বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর করে এবং তাদের নিগ্রহের জেরে সালমার গর্ভপাত হয়ে যায়।
সালমার দাবি, ‘‘সেই সময় থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশ মামলা রুজু না করে দু’পক্ষকে ডেকে মিটমাট করে দিয়েছিল। পুলিশ প্রথম থেকেই তৎপর হলে আজ আমার এই অবস্থা হয় না।’’
ভারপ্রাপ্ত গোয়েন্দাপ্রধান বিশাল গর্গ বলেন, ‘‘এটা তো আমি জানি না। খোঁজ নিতে হবে। তবে শুক্রবার রাতের খুনের ঘটনায় এক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের খোঁজেও তল্লাশি চলছে।’’
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, শুক্রবার রাতের দিকে বাড়ির কাছেই দুই বন্ধুর সঙ্গে গল্প করছিলেন নজরুল। হঠাৎই সাড়ে ১২টা নাগাদ স্বামীর চিৎকার শুনতে পান সালমা। প্রতিবেশীরা জানান, তাঁরা গিয়ে দেখেন নজরুল রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন।
নজরুলের দাদা, প্রত্যক্ষদর্শী রিয়াজ ইসলাম বলেন, ‘‘হঠাৎই জনা দশেক লোক ছুটে এসে ভাইয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওদের মধ্যে এলাকার দাগী দুষ্কৃতী নাসিমও ছিল। সে রড দিয়ে মারে। বাধা দিতে গেলে আমাকেও মারা হয়। এর পর আলম বড় পাথর ছুঁড়ে ভাইয়ের মাথায় মারে।’’ রিয়াজ জানান, শুক্রবার দুপুরে ওই নাসিম-ই হুকিং কাটতে যাওয়া সিইএসসি-র কর্মীদের সঙ্গে বচসায় জড়িয়েছিল।
এই ভাবে এক প্রতিবাদীকে খুন করার ঘটনা মেনে নিতে পারছেন না লিচুবাগান বস্তির বাসিন্দারা। শনিবার বিকেলে নজরুলের দেহ নিয়ে মেটিয়াবুরুজ থানায় বিক্ষোভ দেখান এলাকার কয়েকশো মানুষ। আধ ঘণ্টা পথ অবরোধও করা হয়।