ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে দুর্বৃত্তদের যোগাযোগ অমোঘ! এই সারসত্যই আবার সামনে আনল আরাবুল-কাণ্ড। এলাকা দখল এবং বিরোধীদের সাফ করতে আরাবুল ইসলামকে ব্যবহার করার পরে যখন চাপে পড়ে প্রাক্তন বিধায়কের দায় ঝেড়ে ফেলল শাসক দল।
রাজনীতির সঙ্গে দুর্বৃত্তদের এই যোগসাজশ অবশ্য নতুন নয়। বরং বহু যুগের ঐতিহ্য! এই বাংলাতেও সুদূর অতীতে কংগ্রেস আমলে দুর্বৃত্তদের সঙ্গে রাখার অভিযোগ ছিল তৎকালীন শাসক দলের বিরুদ্ধে। বাম আমলে সেই অভিযোগই আরও জোরালো হয়েছিল। দীর্ঘদিন সিপিএমের শাসন বজায় থাকায় জেলায় জেলায় শাসক দলের হয়ে অত্যাচারের ঘটনায় নাম জড়িয়েছিল সমাজবিরোধীদের। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন থেকে কয়েক বছর আগে কিছু দুষ্কৃতীর গ্রেফতারের পরে তাদের সঙ্গে তদানীন্তন এক ডাকসাইটে মন্ত্রীর যোগাযোগের অভিযোগ সামনে এসেছিল যথেষ্ট প্রকট ভাবেই। তৃণমূলের জমানায় আরও অনেক কিছুর মতোই রাজনীতি-দুষ্কৃতী অংশীদারিত্বও অনেক প্রগাঢ় এবং বেপরোয়া হয়েছে। যে কারণে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো বিরোধী নেতারা তৃণমূলকে ‘আগাপাশতলা সমাজবিরোধীদের দল’ বলে আক্রমণের সুযোগ পেয়েছেন!
ইতিহাস বলছে, রাজনীতির সঙ্গে দুর্বৃত্তদের যোগসাজশের ঘটনা নতুন নয় ঠিকই। তবে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের এখনকার চেহারাটি নতুন। আগেও এলাকায় দাপট রাখার জন্য, পরিস্থিতি ‘সামলে দেওয়া’র জন্য দুর্বৃত্তের সাহায্য নিয়েছে রাজনৈতিক দল। কিন্তু তারা এ ভাবে সামনে এসে ছড়ি ঘোরায়নি। তাদের হাতে দলের কর্তৃত্বও তুলে দেওয়া হয়নি। তৃণমূলের জমানায় সে সবই নিয়ন্ত্রণহীন! যে বাম জমানার বিরুদ্ধে দুর্বৃত্তায়নকে প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার অভিযোগ, এমনকী তখনও কিছু আগল অন্তত চোখে পড়ত। যে কারণে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহম্মদ সেলিম দাবি করতে পারছেন, “দুর্বৃত্তস্থানীয় এবং আরও অনেক ধরনের লোকজন সব সময়ই শাসক দলের দিকে আসতে চায়। আমাদের আমলে কেউ কোনও গণ্ডগোল পাকায়নি, এমন কথা কখনওই আমরা বলিনি। কিন্তু সর্বত্র তারা পার্টির নেতা হয়ে ওঠেনি। প্রশাসনের শীর্ষ স্তর থেকে ‘তাজা ছেলে’ ইত্যাদি বলে তাদের মহিমান্বিতও করা হয়নি!”
বাম আমলে দুই মেদিনীপুরে রক্তপাতে অভিযুক্ত তপন ঘোষ-সুকুর আলিকে ‘দলের সম্পদ’ বলে শংসাপত্র দিয়েছিলেন সিপিএমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ জেলা সম্পাদক দীপক সরকার। তৃণমূল জমানায় আরাবুলদের ‘তাজা ছেলে’ বলে পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন মন্ত্রী মদন মিত্র, ফিরহাদ হাকিমেরা। নানা কাণ্ডে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ছোট ঘটনা, তুচ্ছ ঘটনা, সাজানো ঘটনা’ বলে লঘু করেছেন যাবতীয় অভিযোগ। আহমেদ হাসান ইমরান থেকে কে ডি সিংহ, তৃণমূলের একের পর এক সাংসদ-বিধায়কদের নাম জড়িয়েছে বহু বিতর্কে, অভিযোগ উঠে এসেছে ভূরি ভূরি। বিজেপির বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য তাই প্রশ্ন তুলেছেন, “আরাবুল তো একা নন! আরও কত অজস্র ভীমরুল চার দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে! তাদের কী হবে?”
রাজনীতি যেমন দুর্বৃত্তদের সাহায্য নিয়েছে, তেমনই চির কালই দেখা গিয়েছে দলের মধ্যে এই ধরনের চরিত্রদের মাথার উপরে কোনও না কোনও ‘গডফাদার’ থেকেছে। লেকটাউনের পিনাকীর পিছনে যদি তৎকালীন মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর ছায়া থেকে থাকে, মধ্য কলকাতায় একাধিক অস্বচ্ছ চরিত্রের পিছনে কংগ্রেসের সোমেন মিত্রের নাম থেকে থাকে, এখনও আরাবুলের মাথায় তৃণমূলের মহাসচিব তথা রাজ্যের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বরহস্ত থেকেছে! পার্থবাবু অবশ্য এমন অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর মন্তব্য, “আমি কারও গডফাদার নই! আমি শুধু এক কন্যার ফাদার। সে লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সে আছে, বোমা বাঁধে না!” পার্থবাবুর আরও বক্তব্য, “গডফাদার কেউ হয়ে থাকলে সেটা দল। সেই দলই কিন্তু ভাবমূর্তি নষ্ট করার অপরাধে আরাবুলকে ক্ষমা করেনি।”
পার্থবাবু শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পরে বিকাশ ভবনে গিয়ে তাঁকে ‘গুরু’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন আরাবুল। যা থেকে আরাবুল-পার্থ সম্পর্ক নিয়ে নানা গুঞ্জন ছড়িয়েছে। পার্থবাবুর অবশ্য পাল্টা যুক্তি, “আরাবুল তৃণমূলে আছে প্রথম দিন থেকে। আর আমি তৃণমূলে যোগ দিয়েছি ২০০১ সালে। আমি ওর অভিভাবক হওয়ার কে?” তৃণমূলেরই একাংশের আরও বক্তব্য, ভাঙড় কলেজের সভাপতি হয়ে শিক্ষিকাকে যখন জগ ছুড়ে মেরেছিলেন আরাবুল, তখন পার্থবাবু শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন না। অষ্টম শ্রেণি পাশ আরাবুলের দৃষ্টান্ত মাথায় রেখেই পার্থবাবু কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি হতে গেলে অন্তত স্নাতক হওয়ার নিয়ম চালু করেছিলেন। যদিও তৃণমূলেরই অন্য অংশের দাবি, পার্থবাবুর ছায়া না থাকলে আরাবুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এত দেরি হতো না!
বীরভূমে অনুব্রত মণ্ডল-ঘনিষ্ঠ সুদীপ্ত ঘোষকে পদ থেকে সরিয়ে এবং আরাবুলকে বহিষ্কার করে তৃণমূলে ‘শুদ্ধকরণ’ শুরু হয়েছে বলে দাবি করেছেন পার্থবাবু। তাঁর আরও দাবি, অন্য দলকেও এই কাজ করতে হবে। সেই সূত্রেই মঙ্গলবার তাঁর মন্তব্য, “কংগ্রেসে শুদ্ধকরণ করলে আগে এ রাজ্যে অধীর চৌধুরীকে সরাতে হবে!” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর আবার পাল্টা কটাক্ষ ফিরিয়ে দিয়েছেন, “চোরের মুখে ধর্মের কথা শুনতে আমরা বসে নেই! আরাবুলের ‘গুরু’ শুদ্ধকরণ কী করে জানবেন?’’ অধীরের আরও বক্তব্য, “আরাবুলের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, আইনত তার শাস্তি দিতে পারে পুলিশ ও আদালত। এখন দলের বহিষ্কার মানে চাপে পড়ে ঝেড়ে ফেলা! বাংলার মানুষকে এত বোকা ভাবার কারণ নেই!”