রাম ঠেকিয়ে তৃণমূলের মহাপতন রুখল বাম

তিন বছর আগের বিধানসভা নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করলে বামফ্রন্টের ভোট এ বার ২৬% থেকে কমে ৭.৫২%-এ নেমে এসেছে।

Advertisement

সন্দীপন চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৯ ০৪:২৫
Share:

—ফাইল চিত্র।

বাম ভোট রামে গিয়েই বঙ্গে এ বার পদ্মের বাগান সেজে উঠেছে। নিজেদের বিপত্তির জন্য বামেদের এই ‘ভূমিকা’কে দায়ী করছেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। ভোটের বাস্তব চিত্র বলছে,বাম ভোট পেয়ে রাম শিবির উপকৃত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু মমতার দলও আরও বড় বিড়ম্বনা এড়াতে পেরেছে বামেদের সৌজন্যে! তাঁদের এলাকায় বামেরা রামকে না ঠেকালে তৃণমূলের অন্তত ৮ প্রার্থীর এ বার আর লোকসভায় যাওয়া হত না!

Advertisement

তিন বছর আগের বিধানসভা নির্বাচনের সঙ্গে তুলনা করলে বামফ্রন্টের ভোট এ বার ২৬% থেকে কমে ৭.৫২%-এ নেমে এসেছে। বিজেপির ভোট ১০.১৬% থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০.২৩%। স্বাধীন বাংলার নির্বাচনী ইতিহাসে এ বারই রাজ্য দেখেছে ভোটের সর্বোচ্চ ‘স্যুইং’। শতাংশের হিসেব ধরে বামেদের ভোট শুধু রাম-বাক্সে গিয়ে পড়া নিয়ে চর্চা হচ্ছে। কিন্তু শতাংশের মোড়ক ছাড়িয়ে আসনভিত্তিক হিসেবে ঢুকলে অন্য ছবিও আছে। যেখানে ধরা পড়ছে, প্রবল রক্তক্ষরণের মধ্যেও বামেরা যা ভোট পেয়েছে, তার সব যদি তারা তৃণমূল-সহ নানা মহলের অভিযোগ মতো ‘পরিকল্পনামাফিক’ বিজেপির বাক্সে চালান করে দিত, তা হলে গেরুয়া শিবিরের আসন ১৮ থেকে বেড়ে অন্তত ২৬ হতো!বিজেপির পক্ষে ‘স্যুইং’য়ের দাপটে আরও উইকেট হারিয়ে তৃণমূল নেমে আসত ১৪-য়! মাঝে দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে তৃণমূলের আরও উইকেট পতন বাঁচিয়ে দিয়েছেন বাম প্রার্থীরা।

কালীঘাটে শনিবারই তৃণমূলের নবনির্বাচিত সংসদীয় দলের সহকারী নেতা হয়েছেন কাকলি ঘোষ দস্তিদার, সচেতক হয়েছেন কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোটের তথ্য বলছে, কাকলি-কল্যাণদের লোকসভায় ফেরা হত না তাঁদের কেন্দ্রে বাম প্রার্থী যথাক্রমে হরিপদ বিশ্বাস ও তীর্থঙ্কর রায় ১ লক্ষ ২৩ হাজার ৭২৩ এবং ১ লক্ষ ৫২ হাজার ২৮১ ভোট ধরে না রাখলে। তৃণমূলের বর্ষীয়ান নেতা সৌগত রায় আর দিল্লির উড়ান ধরতে যেতেন না, যদি না দমদমে সিপিএম প্রার্থী নেপালদেব ভট্টাচার্য ১ লক্ষ ৬৭ হাজার ৫৯০ ভোট নিজের বাক্সে জমা রাখতেন। সৌগতবাবু বিজেপির শমীক ভট্টাচার্যকে হারিয়েছেন ৫৩ হাজার ভোটে।

Advertisement

একই ভাবেকাকলি, কল্যাণ, সৌগতদের পাশাপাশি কৃষ্ণনগরে মহুয়া মিত্র, হাওড়ায় প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, বীরভূমে শতাব্দী রায়, বর্ধমান পূর্বে সুনীল মণ্ডল, আরামবাগে অপরূপা পোদ্দারদের জয়ও নিশ্চিত হয়েছে বামেদের জন্য। এই সব কেন্দ্রেই তৃণমূল যে ব্যবধানে বিজেপিকে হারিয়েছে, বাম প্রার্থীরা তার চেয়ে বেশি ভোট টেনেছেন। আরামবাগে যেমন তৃণমূল প্রার্থী অপরূপা জিতেছেন ১১৪২ ভোটে, সেখানে সিপিএমের শক্তিমোহন মালিক ১ লক্ষ ৫২০ ভোট পেয়েছেন। বর্ধমান পূর্বে তৃণমূলের সুনীল ৮৯ হাজার ৩১১ ভোটে জিতেছেন, সেখানে সিপিএম প্রার্থী ঈশ্বরচন্দ্র দাসের ভোট ১ লক্ষ ৭৫ হাজার ৫৯২। এমনকি, তৃণমূলের গড় দক্ষিণ কলকাতায় তৃণমূলের মালা রায়ের হাসতে হাসতে জয় (১ লক্ষ ৫৫ হাজার ১৯২ ভোটে) কঠিন হয়ে যেত সিপিএমের নন্দিনী মুখোপাধ্যায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার ২৭৫ ভোট না পেলে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর ওয়ার্ডেও যখন বিজেপি ‘লিড’ নিয়েছে, সেখানে নন্দিনীর লড়াই মালাকে সাহায্যই করেছে বলতে হবে!

বাম নেতারা বারবারই বলছেন, তৃণমূলকে হারানোর লক্ষ্য সামনে রেখে তাঁদের ভোটের বিরাট অংশ বিজেপিতে গিয়েছে। কিন্তু প্রার্থীদের জামানাত খোয়ানো, ‘জাতীয় দলে’র অস্তিত্ব বিপন্ন করার ক্ষতি স্বীকার করে বা ‘টাকার বিনিময়ে’ দলীয় স্তর থেকে বিজেপিকে ভোট হস্তান্তরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল— এমন তত্ত্ব ভিত্তিহীন। আসন ধরে ভোট বিভাজনের তথ্য জেনে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়েরও প্রতিক্রিয়া, ‘‘তার মানে, যেখানে বামেরা লড়াই করতে পেরেছে, সেখানে তারা আত্মসমর্পণ করেনি। কিন্তু যেখানে তারা খুব দুর্বল, সেখানে কোনও নিয়ন্ত্রণ ছিল না।’’ বিজেপি নেতা শমীকের কথায়, ‘‘দমদমে তো এক ভটচাজ্জি আর এক ভটচাজ্জিকে জিততে দেয়নি! সিপিএমের ভোট আর বুথ দখলের জোরে তৃণমূল ২২-এ পৌঁছেছে, নইলে সেটাও হত না!’’

সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘বিজেপি আর তৃণমূল, দু’দলকেই হারানোর ডাক আমরা দিয়েছিলাম। কিন্তু তৃণমূলকেই আগে হারাতে হবে, এই ভাবনা থেকে বাংলায় ভোট হয়েছে। যত নিচু স্তরে ভোটের হিসেব আসবে, তত বোঝা যাবে তৃণমূলের অবস্থা কতটা খারাপ। শুধু বামেদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বাঁচা যাবে?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন