ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের শিলা (বাঁ দিকে), গত বছরের বন্যায় ঘাটালের অবস্থা। নিজস্ব চিত্র
মা নুষ মরণশীল আর ঘাটালে বন্যা হবেই। এ অনিবার্য। সমস্যাটা যদিও অনেক গভীরে।
ব্রিটিশরা চেয়েছিল, ঘাটালে বন্যা হোক। কারণ, তাতে শিলাবতী ও কংসাবতীর দুই তীরের মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব বজায় থাকবে। আগে নাড়াজোল, বর্ধমান, বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুরের রাজারা তাঁদের প্রজাদের স্বার্থে নদীর দুই দিকে উঁচু বাঁধ দিয়ে রাখতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সেই ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। নদীবাঁধ তৈরি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের যৌথ দায়িত্ব পায় কেন্দ্র ও রাজ্য। সেই সমস্যার শুরু।
ফি বছর ঘাটাল মহকুমায় নিয়ম করে বন্যা হয়। বানভাসি হয় ঘাটাল, চন্দ্রকোনা ১ ও ২-সহ বিস্তীর্ণ এলাকা। নিঃস্ব হন বহু মানুষ। প্রশাসন থেকে রাজনৈতিক দলগুলি আশ্বাস দেয়, পরের বার ঠিক সমাধান হয়ে যাবে। বছরের পর বছর আসে, কিন্তু সেই আশ্বাস ভেসে যায় বন্যার জলের তোড়ে। প্রতি বর্ষায় শিলাবতী নদীর দু’কূল ছাপিয়ে বানভাসি হয় মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা।
ঘাটালে বন্যার কারণটা ভৌগোলিক। ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে উৎপন্ন হওয়া শিলাবতী, কংসাবতী, দ্বারকেশ্বর-সহ কয়েকটি নদীর ভূমি ঢাল দীর্ঘপথ অতিক্রম করে ঘাটালের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীগর্ভে পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টি হলেই নদীগুলির দু’পাশের লোকালয় হিসেবে ঘাটাল মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। নষ্ট হয়ে যায় চাষের জমি, বাড়িঘর, রাস্তা।
এই এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার দাবিতে প্রথম সরব হয়েছিলেন ঘাটালের প্রথম সাংসদ নিকুঞ্জবিহারী চৌধুরী। সংসদে তিনি ঘাটালের মানুষের সমস্যাকে সর্বভারতীয় স্তরে তুলে আনেন। তারপর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মন্ত্রিসভা ১৯৫৯ সালে ঘাটাল-সহ সংলগ্ন এলাকার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার জন্য অর্থনীতিবিদ মান সিংহের নেতৃত্বে কমিটি তৈরি করেছিল। কিন্তু সেই কমিটি রিপোর্ট পেশ করতেই পেরিয়ে যায় ২০ বছর। ১৯৭৯ সালে ওই কমিটির পেশ করা রিপোর্টের ভিত্তিতেই কেন্দ্রীয় সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদন পায় ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’। ১৯৮২ সালে ঘাটাল শহরের শিলাবতী নদীর ধারে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের সূচনা হয়েছিল। তখন প্রকল্পের খরচ ধরা হয় ৫০ কোটি টাকা। প্রাথমিক ভাবে ৩০ লক্ষ টাকা অনুমোদনও হয়। ১১৮ কিলোমিটার নদী বাঁধ নির্মাণ-সহ নানা কাজ ওই প্রকল্পে ছিল। মাস্টার প্ল্যানটি কার্যকর হলে উপকৃত হওয়ার কথা ঘাটাল, দাসপুর ১, দাসপুর ২, চন্দ্রকোনা ১, চন্দ্রকোনা ২, কেশপুর, ডেবরা, খড়্গপুর ১, খড়্গপুর ২, মেদিনীপুর, পাঁশকুড়া, কোলাঘাট, ময়না—এই ১৩টি ব্লকের মানুষের। ঘাটাল শহরের পূর্ব পারে শিলাবতীর ধারে রুপোর কোদাল দিয়ে তৎকালীন বাম সরকারের সেচমন্ত্রী প্রভাস রায় সেই প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। কিন্তু কাজ শুরুর কিছু দিন পরেই প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়।
ঠান্ডা ঘরে চলে যাওয়া এই প্রকল্প নিয়ে ২০০৬ সাল থেকে ফের নাড়াচাড়া শুরু হয়। ওই বছর কেন্দ্রের একটি দল ঘাটালে আসে। তাঁদের নির্দেশে ৯০০ কোটি টাকার নতুন প্রকল্প তৈরি হয়। প্রথম ধাপে ৩৫০ কোটি টাকার কাজের সিদ্ধান্তও হয়ে যায়। কিন্তু ওইটুকুই। কেন্দ্র ও রাজ্য—কোনও সরকারই বিষয়টি নিয়ে কোনও উদ্যোগ না নেওয়ায় প্রকল্পটি আবার হিমঘরে চলে যায়। ২০০৯ সালে আবার কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্ত একটি সংস্থা মাস্টার প্ল্যানের জন্য প্রকল্প রিপোর্ট তৈরির কাজ শুরু করে। ২০১৫ সালে প্রথম ধাপের প্রকল্প রিপোর্টের ছাড়পত্র দেয় জিএফসি-র (গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিশন) পূর্বাঞ্চল শাখা। ফাইলটি পাঠিয়ে দেওয়া হয় অর্থ দফতরে। প্রথম দফায় প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল ১২১৪ কোটি ৯২ লক্ষ টাকা। আগে এই ধরনের প্রকল্পে কেন্দ্র ৭৫ শতাংশ ও রাজ্য ২৫ শতাংশ টাকা দিত। কিন্তু নতুন নিয়মে কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়কেই ৫০ শতাংশ করে টাকা দিতে হবে বলা হয়। নতুন প্রকল্পে কম বেশি ১৪৭ কিলোমিটার নদী ও নদীর বাঁধ সংস্কার, নারায়ণী ও কাঁকি খালে দু’টি স্লুইস গেট, পাম্প হাউস, ঘাটাল শহর সংলগ্ন শিলাবতী নদীর বাঁ দিকে দুই কিলোমিটার গার্ডওয়াল-সহ বিভিন্ন কাজ হওয়ার কথা। কিন্তু সবটাই তো খাতায় কলমে। প্রথম ধাপের প্রকল্পটি সবুজ সংকেত পেলেও ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের জন্য এখনও কোনও টাকা বরাদ্দ হয়নি। এ দিকে যত দিন এগোচ্ছে তত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে প্রকল্পের খরচ।
ঘাটালের ভৌগোলিক অবস্থান অনেকটা গামলার মতো আর সেই কারণে বন্যা অনিবার্য, এই যুক্তি কিন্তু ষোলোআনা ঠিক নয়। বরং যুক্তি বলছে, সংকীর্ণ নদীখাত দিয়ে বয়ে আসা জলরাশি ঠিক সময়ে বেরোতে না পারাতেই ঘাটাল বানভাসি হয়। ২০০১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তৈরি হয়েছিল ঘাটাল মহকুমা বন্যা ও ভাঙন প্রতিরোধ কমিটি। তার কয়েক বছর পরে তৈরি হয়েছে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ সংগ্রাম কমিটি। এই দু’টি কমিটি-সহ কয়েকটি সংগঠন বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় নেমে মাস্টার প্ল্যানের কাজ শুরুর দাবিতে আন্দোলন করেছে। সম্প্রতি ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানে অর্থ বরাদ্দের দাবিতে সম্মেলনও হয়েছে।
প্রতি বছরই বর্ষার আগে ঘাটালের বন্যা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অনেক বৈঠক হয়। কিন্ত তার পরেও প্লাবন আটকানো যায় না। যত দিন যাচ্ছে, প্লাবনের তীব্রতা যেন বাড়ছে। গত বছরের বন্যার সময়ে একের পর এক পাকা বাড়ির তাসের ঘরের মতো ভেঙে যাওয়ার দৃশ্য আমাদের চোখে এখনও টাটকা। এ বার জলবন্দিদের উদ্ধার করতে বায়ুসেনাকেও নামতে হয়েছিল। প্রশাসনের অনেক কর্তা ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন,১৯৭৮ সালের পরে এমন ভয়ঙ্কর বন্যা ঘাটালে হয়নি। সর্পদষ্ট হয়ে এবং জলে ডুবে মৃত্যু হয়েছিল চার জনের। চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছেন অনেকে। বন্যার জেরে শুরু হয় জল সংকট। অনেকে আতঙ্কে জমি বাড়ি বেচে ঘাটাল ছে়ড়ে চলে গিয়েছেন। কয়েক মাস পরেই ফের বর্ষা আসছে। ফের আতঙ্কের প্রহর গোনা শুরু হবে ঘাটাল জুড়ে। মাস্টার প্ল্যান কি শুধুই বায়বীয়? জবাব চাইছেন ঘাটালবাসী।
লেখক সমাজকর্মী