বিয়ের আসরে অতনু ও যমুনা। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
মূল ফটকের বাইরে থেকে ভেসে আসছে সানাইয়ের সুর। ভিতরে ঢুকতেই গোলাপ হাতে ছুটে এল শাড়ি পরা দুই কিশোরী। একটা ফুল হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘‘উপরে চলে যান। সব কিছু তো ওখানেই হচ্ছে।’’
লাল পাড়ের হলুদ বেনারসি পরা ছোটখাটো চেহারার মেয়েটির কপালে চন্দন দিয়ে আলপনা এঁকে দিচ্ছেন এক তরুণী। কনেকে ঘিরে এক ঝাঁক চোদ্দো-পনেরোর বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। কেউ শাড়ি, তো কেউ নতুন সালোয়ার-কামিজ। ওদের খোঁপায় বাঁধা গোলাপ আর রজনীগন্ধার গন্ধে গোটা বাড়িটা ভাসছে।
সোমবার, মাঝ-ফাগুনের দুপুরে উত্তরপাড়ার এই সরকারি হোম রাতারাতি একটা বিয়েবাড়ির চেহারা নিয়েছে। হবে না-ই বা কেন? হোমের আবাসিক যমুনা মালের বিয়ে যে!
পাত্র লেক টাউনের অতনু বসাক। সুদর্শন, পেশায় ব্যবসায়ী। রীতিমতো সম্বন্ধ করে বিয়ে। কী ভাবে হল এই সম্বন্ধ? হোমের সুপার শীলা কুণ্ডি জানালেন, গত বছর এপ্রিলে এক দিন হঠাৎ তাঁর কাছে ফোন আসে। ও-প্রান্তে এক মহিলা সন্ধ্যা বসাক নামে নিজের পরিচয় দিয়ে জানতে চান, হোমে কি কোনও বিবাহযোগ্য মেয়ে রয়েছে? শীলাদেবীর কথায়, ‘‘প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। জিজ্ঞাসা করি, হঠাৎ এই প্রশ্ন করছেন কেন? মহিলা জানান, তাঁর স্বামী এবং বড় ছেলে ন’বছর আগে মারা গিয়েছেন। এখন ছোট ছেলের বিয়ে দেবেন ঠিক করেছেন। কিন্তু কোনও বড় ঘরের মেয়ে নয়। তাঁর ইচ্ছে, বৌমা কোনও গরিব ঘরের মেয়ে হোক।’’
রাজ্যের শিশু ও সমাজকল্যাণ দফতরের অধীন উত্তরপাড়ার এই হোমটি আসলে শুধুমাত্র নাবালিকা আবাসিকদের জন্য। কিন্তু অনেকেই বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য হোমে থেকে যান। যেমন যমুনা। বছর পঁচিশের অনাথ এই মেয়ে ছোট থেকে বহরমপুর, মেদিনীপুর, লিলুয়া-সহ রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি হোম ঘুরে উত্তরপাড়ার এসেছিলেন টেলারিংয়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বনির্ভর হতে।
সন্ধ্যাদেবীর কথা শুনে যমুনার কথাই মনে পড়ে সুপারের। এই মুহূর্তে সে-ই একমাত্র বিবাহযোগ্যা। পাত্রের মাকে সেটা জানান তিনি। তার পর এক দিন হোমেই যমুনাকে দেখতে যান মা, ছেলে ও ছেলের এক বন্ধু। যমুনাকে পছন্দ হয়ে যায় তাঁদের। শুরু হয় রাজকন্যেকে বাড়ি আনার তোড়জোড়। সে-ও তো কম কথা নয়।
নিয়ম বলছে, সরকারি হোমের কোনও মেয়েকে পছন্দ হলেই বিয়ে হয় না। এ জন্য দরকার সমাজকল্যাণ দফতরের ছাড়পত্র। যা পেতে হলে পাত্র ও তাঁর বাড়ির সম্পর্কে বিশদ তথ্য দিতে হবে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলাশাসক এবং পুলিশকে। যমুনা-অতনুর চার হাত এক করতে মে মাস থেকে শুরু হয় প্রশাসনের অনুসন্ধান পর্ব। ছেলের বাড়ি থেকে মেয়ে দেখে পছন্দ করার পরেই লেক টাউনে অতনুদের বাড়িতে লোক পাঠিয়ে খোঁজখবর নেওয়া শুরু হয়। ছেলের পরিবারে কে আছেন, বাড়ি নিজেদের কি না, ছেলে কী করেন, তাঁর আচার-আচরণ কেমন, পড়শিরা কী চোখে দেখেন এই পরিবার ও ছেলেটিকে— এমন নানা বিষয়ে খোঁজখবর। কখনও সরকারি কর্তা, কখনও পুলিশ, কখনও উত্তরপাড়া হোমের লোকজন— গত দশ মাস ধরে এমন ‘ধৈর্য আর অগ্নিপরীক্ষার’ পথ পেরিয়ে অবশেষে যমুনাকে বিয়ে করার ছাড়পত্র মেলে এ মাসেই।
এ দিন কয়েক ঘণ্টার জন্য ‘বিয়ে বাড়ি’ হয়ে উঠেছিল উত্তরপাড়ার এই হোম। একটু আগেই রেজিষ্ট্রি বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ঠিক ছিল, তার পরেই মেয়েকে নিয়ে রওনা দেবেন সন্ধ্যাদেবী। কিন্তু বেঁকে বসেন আবাসিকরা। তাঁদের আবদার মেনে শেষমেশ সামাজিক নিয়ম মেনে মালাবদল সারেন অতনু-যমুনা। সুপার সম্প্রদান করেন। শাঁখ বাজানো, উলু দেওয়া, অতিথি আপ্যায়ণ— সব কাজেই তখন কচিকাঁচাদের দাপট। তার পর বিকেল গড়াতেই ইন্দ্রাণী, অঙ্কিতা, জয়ন্তী, ষষ্ঠীদের চোখ ভিজে ওঠে। শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে যে যমুনাদিদি!
এত গরিব মেয়ে থাকতে হোমের মেয়ে কেন? অতনু বললেন, ‘‘আমার এক বন্ধু বলল, গরিব মেয়েকেই যখন বিয়ে করবি, তখন হোমের মেয়ে নয় কেন? কথাটা ভাল লেগেছিল। মাকে তাই বললাম।’’ তার পরেই লাজুক স্বীকারোক্তি তরুণের— ‘‘ওকে প্রথম দিন দেখেই পছন্দ হয়েছিল। একটা ঘরোয়া মেয়ে চেয়েছিলাম। যমুনা অনেক দিন হোমে রয়েছে। সবাইকে নিয়ে থাকার অভ্যাস আছে। মনে হল, ও-ই উপযুক্ত।’’
পুত্রবধূকে ঘরে নিয়ে যেতে পেরে কেমন লাগছে? খুশি-খুশি গলায় পাত্রের মা বললেন, ‘‘সেই ২০০৮ সালে স্বামী আর বড় ছেলেকে হারিয়েছি। বাড়িতে শুধু আমি আর অতনু। অনেক দিন ধরেই ওর বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছিলাম।’’ আত্মীয়-স্বজনেরা কেউ আপত্তি করেননি? সন্ধ্যাদেবীর চোয়াল শক্ত, ‘‘প্রথমে একটু আপত্তি করলেও আমি জেদ ধরে ছিলাম। আর কেউ কিছু বলার সাহস পায়নি।’’
বধূবরণের পালা শেষ। বসাক-বাড়িতে কাল বৌভাত।