পর্যটনকেন্দ্র হবে মাহেশ, প্রকল্প তৈরির কাজ শুরু

রথযাত্রার মুখে শ্রীরামপুরের মাহেশকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্যোগী হল পুরসভা। শুরু হল এ সংক্রান্ত প্রক্রিয়া। গত বছরের ৮ জুলাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চণ্ডীতলায় প্রশাসনিক বৈঠক করতে এলে শ্রীরামপুরের বিধায়ক সুদীপ্ত রায় মাহেশকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়টি উত্থাপন করেন। মুখ্যমন্ত্রী প্রস্তাবটি গ্রহণ করে জেলাশাসককে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে বলেন।

Advertisement

প্রকাশ পাল

শ্রীরামপুর শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৫ ০০:৫১
Share:

রথযাত্রার মুখে শ্রীরামপুরের মাহেশকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্যোগী হল পুরসভা। শুরু হল এ সংক্রান্ত প্রক্রিয়া।

Advertisement

গত বছরের ৮ জুলাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চণ্ডীতলায় প্রশাসনিক বৈঠক করতে এলে শ্রীরামপুরের বিধায়ক সুদীপ্ত রায় মাহেশকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়টি উত্থাপন করেন। মুখ্যমন্ত্রী প্রস্তাবটি গ্রহণ করে জেলাশাসককে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে বলেন। সম্প্রতি চুঁচুড়ায় জেলা পরিষদ ভবনে প্রশাসনিক বৈঠকেও মুখ্যমন্ত্রীর সামনে ফের বিষয়টি তোলেন সুদীপ্তবাবু। এর পরেই প্রশাসনের তরফে তৎপরতা শুরু হয়। পর্যটন দফতরের চিঠির প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসনের তরফে শ্রীরামপুর পুরসভাকে চিঠি দিয়ে প্রকল্পের বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়ে পাঠানো হয়েছে সম্প্রতি। ইতিমধ্যে পুরসভার তরফে সেই রিপোর্ট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।

শ্রীরামপুরের পুরপ্রধান অমিয় মুখোপাধ্যায় জানান, এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞকে রিপোর্ট তৈরি করতে বলা হয়েছে। গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে পুণ্যার্থীদের জন্য যাত্রীনিবাস, শৌচাগার, জগন্নাথ বাড়ি থেকে মাহেশ পর্যন্ত পানীয় জলের সুবন্দোবস্ত, রাস্তা জুড়ে বাহারি আলো লাগানোর উপরে। ‘মাসির বাড়ি’ (রথে চেপে এসে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা যে মন্দিরে থাকেন) চত্বরও ঢেলে সাজার পরিকল্পনা রয়েছে।

Advertisement

মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের সেবাইত তথা শ্রীরামপুর পুরসভার কাউন্সিলর অসীম পণ্ডিত বলেন, ‘‘আশা করছি শীঘ্রই রিপোর্ট মিলবে। তার পরেই তা জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানো হবে।’’ বিধায়ক সুদীপ্তবাবু বলেন, ‘‘এখানকার রথযাত্রার প্রাচীনত্ব এবং ঐতিহ্যের কথা মাথায় রেখে মাহেশে পর্যটনকেন্দ্র গড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে এই প্রকল্পে সম্মতি দিয়েছেন।’’

মাহেশের রথযাত্রা ছয় শতাব্দী প্রাচীন। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাধারাণী’ গল্পেও এই রথযাত্রার উল্লেখ রয়েছে। ইতিহাস অনুযায়ী, পুরীতে যাওয়ার পথে মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরে এসেছিলেন চৈতন্যদেব। পুরীকে বলা হয় নীলাচল। চৈতন্যদেব মাহেশকে ‘নব নীলাচল’ আখ্যা দেন। প্রতি বছর রথযাত্রার সময়ে এখানে অগণিত মানুষের সমাগম হয়।

পুরীতে এ বছর নবকলেবর। মাহেশেও পালিত হচ্ছে ওই উৎসব। তবে, পুরীর মতো এখানে বিগ্রহ বদল হয় না। জগন্নাথ মন্দিরের সেবাইতরা জানান, ৬১৯ বছর আগে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক ভক্ত পুরীতে গিয়ে জগন্নাথের দর্শন না পেয়ে বিহ্বল হয়ে পড়েন। পরে জগন্নাথের স্বপ্নাদেশ পেয়ে মাহেশে প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝার রাতে গঙ্গায় ভাসমান একটি নিমকাঠ পান। তা দিয়েই জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। সেই বিগ্রহই আজও পূজিত হচ্ছে। একেবারে প্রথমে রথ চলত চাতরায় গুণ্ডিচাবাটি পর্যন্ত। বর্তমান লোহার রথটি ১৮৮৪ সালে শ্যামবাজারের বসু পরিবারের কর্তা কৃষ্ণচন্দ্র বসু তৈরি করিয়ে দেন। ২০ লক্ষ টাকায় রথটি তৈরি করেছিল মার্টিন বার্ন কোম্পানি। ১৮৮৫ সাল থেকে ওই রথে টান শুরু হয়। চার তলা রথটি ৫০ ফুট লম্বা। ওজন ১২৫ টন। এক ফুট বেড়ের ১২টি লোহার চাকা রয়েছে। সোজারথ এবং উল্টোরথের দিন তামার দু’টি ঘোড়া রথের সামনে লাগানো হয়।

মন্দির কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, এমন ঐতিহ্যের জন্যই বহু বছর ধরে মাহেশের রথ, জগন্নাথ মন্দির, মাসির বাড়িকে ঘিরে হেরিটেজ জোন বা পর্যটন কেন্দ্র করার আবেদন জানিয়েছেন তাঁরা। এই স্থানকে পর্যটন মানচিত্রে তুলে ধরার দাবি রয়েছে মাহেশ তথা শ্রীরামপুরবাসীরও। কয়েক বছর আগে (বাম আমলে) শ্রীরামপুরের তৎকালীন বিধায়ক রত্না দে নাগ রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রীকে চিঠিও দিয়েছিলেন মাহেশকে ‘হেরিটেজ জোন’ ঘোষণার আবেদন জানিয়ে। পরবর্তী সময়ে সুদীপ্তবাবুও বিধানসভার অধিবেশনে বিষয়টি তোলেন। কিন্তু মাহেশ বঞ্চিতই থেকেছে। এত দিনে সরকারি স্তরে বিষয়টি নিয়ে নড়াচড়া হওয়ায় মন্দির কর্তৃপক্ষ আশার আলো দেখছেন।

নবকলেবর উপলক্ষে এ বার মাহেশেও বিশেষ পুজো হবে। সাধু-সন্তরা আসবেন। বিগ্রহের জন্য নতুন লেপ, কম্বল কেনা হয়েছে। শুরু হয়েছে মন্দির রং করা। এ দিকে, প্রথামাফিক স্নানযাত্রার দিন প্রচুর দুধ ও গঙ্গাজলে স্নান করে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার জ্বর এসেছে। কবিরাজদের দেওয়া পাচন খাচ্ছেন তাঁরা। রথযাত্রার এক দিন আগে ‘রাজা’ হিসেবে অভিষেক হবে জগন্নাথের। সোজারথের দিন রথে চাপিয়ে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হবে সখী পৌর্ণমসীর বাড়িতে। প্রচলিত কথায় যা ‘মাসির বাড়ি’।

মন্দিরের প্রধান সেবাইত সৌমেন অধিকারী বলেন, ‘‘সারা বছর এখানে পুণ্যার্থী আসেন। রথযাত্রায় মানুষের ঢল নামে। কিন্তু পরিকাঠামোর অভাবে পুণ্যার্থীদের সমস্যায় পড়তে হয়। এ বার আশা করছি সরকার উপযুক্ত পদক্ষেপ করবে।’’

আশায় রয়েছেন শহরের বাসিন্দারাও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন