রাজভবন থেকে বেরোনোর পথে পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ। শুক্রবার সুমন বল্লভের ছবি।
শিক্ষামন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রসচিবের ব্যাখ্যা শোনা হয়ে গিয়েছিল বৃহস্পতিবারই। যাদবপুরের ঘটনা নিয়ে শুক্রবার তবু কলকাতার পুলিশ কমিশনারকে তলব করলেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী। এর পরে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত পড়ুয়াদের বক্তব্য শুনতে চান। যাদবপুরের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা এবং প্রশাসনের ব্যাখ্যায় তিনি যে সন্তুষ্ট নন, রাজ্যপালের পদক্ষেপে এই বার্তাই স্পষ্ট বলে প্রশাসনের একাংশ মনে করছে।
রাজভবন সূত্রের খবর, যাদবপুরে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ বৃহস্পতিবার সাংবাদিক সম্মেলনে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে বহু অসঙ্গতি ধরা পড়েছে। সেই ধন্দ কাটাতেই পুলিশ কমিশনারকে ডেকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন রাজ্যপাল। কিন্তু পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে প্রশ্ন থাকলে রাজ্যপাল সাধারণত স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছ থেকেই রিপোর্ট নেন। যাদবপুর নিয়ে স্বরাষ্ট্রসচিবের বক্তব্য শোনার পরেও সিপি-কে ডেকে পাঠানোটা তাই তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছে প্রশাসনের একটি অংশ। সন্দেহ নেই এর ফলে চাপে পড়ল রাজ্য প্রশাসন।
যাদবপুর নিয়ে রাজভবন সক্রিয় হয়েছে খবর পেয়ে তৎপরতা শুরু হয় রাজ্য প্রশাসনেও। রাজ্যপালের ডাক আসার বিষয়টি সিপি নবান্নে জানান। সেখানে তাঁকে ডেকে পাঠান স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রীও ওই সময় নবান্নেই ছিলেন। কিছু ক্ষণ পরে সিপি-কে স্বরাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে একই গাড়িতে নবান্ন থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়। বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রসচিব রাজ্যপালকে কী বলেছিলেন, এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে রাজভবনে গিয়ে সিপি-কে কী বলতে হবে, তা জানাতেই সুরজিৎবাবুকে নবান্নে ডেকে পাঠানো হয়েছিল বলে স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর। রাজ্যপালের সঙ্গে এ দিন তাঁর কী কথা হয়েছে, সে ব্যাপারে সিপি অবশ্য মুখ খোলেননি। রাতে তাঁকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী
বৃহস্পতিবারই শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, স্বরাষ্ট্রসচিব এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে আলাদা আলাদা ভাবে ডেকে পাঠিয়েছিলেন রাজ্যপাল। মঙ্গলবারের বিক্ষোভের পিছনে মাওবাদীদের হাত রয়েছে এবং তারা উপাচার্যকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল, এমন একটি ধারণা দেওয়া হয় রাজ্যপালকে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে পুলিশ কমিশনারের বিবৃতি দেখার পরে রাজ্যপাল সংশয়ী হয়ে ওঠেন বলে রাজভবন সূত্রের খবর। তার সঙ্গে বিরোধীরাও ক্রমাগত চাপ বাড়িয়ে গিয়েছেন সরকারের উপরে। এ দিনই সকালে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। সাক্ষাতের পরে অধীরবাবু জানান, সত্য ঢাকতে পুলিশ কমিশনার মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন, এই অভিযোগই রাজ্যপালকে করেছেন তিনি। যাদবপুরের ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত এবং উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীর অপসারণও দাবি করেন অধীরবাবু।
চাপ আসে রাজ্য বিজেপির পক্ষ থেকেও। এ রাজ্যের বিজেপি নেতারা দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে এই বলে দরবার করেন যে, এত গুরুতর ঘটনায় রাজভবনের দিকেই তাঁরা তাকিয়ে আছেন। এই পরিস্থিতিতেই ‘সক্রিয়’ হন রাজ্যপাল। সকালে রাজভবন থেকে বেরিয়ে অধীরবাবু ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, রাজ্যপাল সিপি-কে ডাকতে পারেন। সন্ধ্যাতেই ডাক পড়ে সুরজিৎবাবুর।
রাজ্যপালের কাছে তিনি কী ব্যাখ্যা দিয়েছেন, সিপি তা প্রকাশ্যে না জানালেও রাজ্য সরকার যে নিজেদের অবস্থানে অনড় সেটা এ দিন শিক্ষামন্ত্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন। মঙ্গলবার রাতে উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী ক্যাম্পাসে ‘বহিরাগতদের’ উপস্থিতির দাবি করেছিলেন। বৃহস্পতিবার তাঁর সাংবাদিক সম্মেলনে সেই তত্ত্বকেই এগিয়ে নিয়ে যান সিপি। একই সুরে কথা বলেন শিক্ষামন্ত্রীও। পার্থবাবু এ দিন ফের দাবি করেন, উপাচার্য-সহ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ তাঁদের প্রাণসংশয় হয়েছে বলে জানানোর ফলেই পুলিশ সেই রাতে ক্যাম্পাসে যেতে বাধ্য হয়েছিল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম-সমর্থিত শিক্ষক সংগঠন জুটার প্রতিনিধিরা এ দিন শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলে তিনি তাঁদের কাছে ঘটনার ফুটেজও চান।
জুটার সম্পাদক পার্থপ্রতিম বিশ্বাস অবশ্য দাবি করেন, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা সদর্থক ছিল। শিক্ষামন্ত্রী তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা নেবেন বলে তাঁদের জানিয়েছেন। শিক্ষকদের কাছ থেকে পুলিশের ভূমিকা সম্পর্কে জানার পরে তাঁদের কাছে কোনও ফুটেজ থাকলে তা চেয়েছেন।
কিন্তু ফুটেজ পেলে কি পুলিশের ভূমিকার তদন্ত হবে? শিক্ষামন্ত্রীর জবাব, “আগে তো ফুটেজ আসুক! তদন্তের কথা এখনই উঠছে কেন? আসল তদন্ত তো হচ্ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ নিয়ে। সেই তদন্তকে যথাযথ ভাবে করতে না-দেওয়ার জন্য বহিরাগতদের প্রভাবে একটা ঘটনা ঘটানো হয়েছে।”
জুটার প্রতিনিধিরা কিন্তু পুরো ঘটনার তদন্ত এবং উপাচার্য পদ থেকে অভিজিৎবাবুর অপসারণ না-হওয়া পর্যন্ত পঠন-পাঠন, গবেষণার কাজ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজে কোনও সহযোগিতা করবেন না বলে জানিয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী তবু ফের বলেছেন, “শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পঠনপাঠনই আসল কথা। ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক, শিক্ষক সকলের কাছে আবেদন, যাদবপুরে যে অচলায়তন তৈরি হয়েছে, তার থেকে সরে আসুন। শিক্ষকদের বলব, ছাত্রছাত্রীদের বোঝান, ঘেরাও আন্দোলন উপযুক্ত পথ নয়।” এ দিন ছাত্রছাত্রীদের প্রতিও তাঁর বার্তা, “বহিরাগতদের প্রভাবে পড়াশোনা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে দিকে সচেতন থাকুন!”
বিরোধীদের তোপ অবশ্য অব্যাহত। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু জানিয়েছেন, ২২ সেপ্টেম্বর সারদা মামলায় দোষীদের শাস্তির দাবিতে বামফ্রন্টের মহামিছিলে যাদবপুরের বিষয়টিও যুক্ত করা হয়েছে।