অভিযোগটা নানা মহল থেকেই উঠছিল। এমনকী, রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র সরাসরি চিঠি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। অভিযোগ করেছিলেন, এখনকার চিকিৎসকদের অনেকেই ‘গ্রেস’ নম্বরের কল্যাণে পাশ করছেন ও বেছে-বেছে শাসক-ঘনিষ্ঠ ডাক্তারি পড়ুয়াদের গ্রেস দিয়ে পাশ করানো হচ্ছে। কিন্তু তখন তা সরাসরি কেউ মানেননি। এ বার স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তে কার্যত সেই অভিযোগেই সিলমোহর পড়ল।
সিদ্ধান্ত হয়েছে, চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে রাজ্যে ডাক্তারি স্নাতকোত্তরের (এমডি, এমএস) পরীক্ষার্থীদের পাশ করানোর জন্য আর ‘গ্রেস মার্কস’ দেওয়া হবে না। পাশাপাশি, নিজেদের মেডিক্যাল কলেজে (হোম সেন্টারে) পড়ুয়াদের খাতা দেখার যে পদ্ধতি চালু ছিল, তা-ও উঠে যাচ্ছে। লেখা পরীক্ষার সব খাতা এ বার থেকে কেন্দ্রীয় ভাবে সল্টলেকে রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা হবে। কারা খাতা দেখছেন, সে সম্পর্কে ধারণাই থাকবে না পরীক্ষার্থীদের। চলতি শিক্ষাবর্ষের এমডি, এমএস-এর থিওরি পরীক্ষা মে মাসের প্রথম সপ্তাহে হয়ে গিয়েছে। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা চলছে। ফল প্রকাশ হবে জুন মাসে।
কেন পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন? রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবতোষ বিশ্বাস বলেন, ‘‘ভবিষ্যতের বিশেষ়জ্ঞ চিকিৎসকদের মূল্যায়ন পদ্ধতি নিরপেক্ষ ও পরীক্ষা পদ্ধতি স্বচ্ছ করাই উদ্দেশ্য।’’ সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘‘আমি আগেই লিখিত অভিযোগ জানিয়েছিলাম। গ্রেস দিয়ে অদক্ষ, অর্ধশিক্ষিত ডাক্তারের সংখ্যা বাড়ছে। তা বন্ধ হলে তো ভালই। তবে ওরা মুখে যতটা বলছে, কাজে কতটা করতে পারবে কি না সন্দেহ রয়েছে।’’
স্বাস্থ্য দফতরের মধ্যে একটা অংশ আবার প্রশ্ন তুলেছে, পাঁচ-ছ’ নম্বরের জন্য এমডি বা এমএসের কোনও পড়ুয়ার পাশ করা আটকে গেলে যদি তাঁকে গ্রেস দেওয়া হয়, তাতে ক্ষতির কী আছে? বরং গ্রেস তুলে দিলে সামান্য নম্বরের জন্য অনেক ভাল ছেলেমেয়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়া আটকে যাবে। এমনিতেই রাজ্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাব। স্নাতকোত্তরে বেশি পড়ুয়া ফেল করলে সংখ্যাটা আরও কমবে। এতে ক্ষতি রাজ্যেরই। ভুগবেন সাধারণ মানুষ। সেই সঙ্গে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের আসনবৃদ্ধির অনুমোদনও আটকে যেতে পারে। রাজ্যের স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য বলেছেন, ‘‘আগে থেকে কেন ধরে নেওয়া হচ্ছে যে, গ্রেস উঠে গেলেই স্নাতকোত্তরে ছেলেমেয়েরা বেশি ফেল করবেন? দেখা যাক কী হয়।’’
স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ভবতোষ বিশ্বাসের আবার দাবি, গ্রেস দেওয়ার ফলে অযোগ্য চিকিৎসকেরা বিশেষজ্ঞ হয়ে যাচ্ছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে, নতুন পদ্ধতি চালু করে সেই অভিযোগকারীদের মুখ বন্ধ করা যাবে। কিন্তু স্বাস্থ্য দফতরের অন্দরে প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি সরাসরি এটাই মেনে নেওয়া হচ্ছে যে, এত দিন যাঁরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হয়েছেন, তাঁরা অনেকেই অযোগ্য? স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যাঁরা আগের পদ্ধতিতে বিশেষজ্ঞ হয়েছি, তাঁদের যোগ্যতা নেই ভাবাটা হাস্যকর। বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে পরীক্ষা পদ্ধতিকে যেতে হয়। কখনও তাতে উন্নতি হয়, কখনও হয় না।’’
তবে ডাক্তারির স্নাতকোত্তর পরীক্ষা পদ্ধতির এই রদবদল নিয়ে ছাত্রছাত্রী ও বিভিন্ন মেডিক্যাল শিক্ষকদের মতভেদ রয়েছে। যেমন এসএসকেএমের অধ্যক্ষ প্রদীপ মিত্রের কথায়, ‘‘একটি ছেলে হয়তো প্র্যাকটিক্যাল-ভাইভা পরীক্ষা খুব ভাল দিল। থিওরিতে কোনও কারণে কয়েক নম্বরের জন্য আটকে গেল। তখন আমরা এক্সটারন্যাল পরীক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে থিওরিতে কয়েক নম্বর গ্রেস দিয়ে পাশ করিয়ে দিই। সেই পথ আটকে গেল। অনেক ভাল ছেলে এর ফলে বিশেষজ্ঞ হতে ধাক্কা খাবে।’’ আবার স্বাস্থ্য দফতর থেকে অবসরপ্রাপ্ত কার্ডিওথোরাসিক সার্জন সিদ্ধার্থ চক্রবর্তীর মতে, হোম সেন্টারে খাতা দেখার সময়ে অনেক ক্ষেত্রে স্বজনপোষণ হত। তাতে যে বিশেষজ্ঞেরা তৈরি হতেন, তাঁরা অনেকেই দক্ষ হতেন না। আবার অনেক সময়ে ইন্টারনাল অধ্যাপকের সঙ্গে সুসম্পর্ক নেই বলে অনেক ভাল ছেলের নম্বর থিওরিতে কমিয়ে দেওয়া হত। নতুন নিয়মে তা ঠেকানো যাবে।
প্রবীণ চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী মনে করছেন, হোম সেন্টারে পরীক্ষার মানেই হয় না। এতে সহজে পাশ করে যাবে মনে করে অনেক ছেলেমেয়ে পড়াশোনাই করে না। পরীক্ষার পদ্ধতিতে নিরপেক্ষতা থাকা উচিত। মেধার ভিত্তিতে ফল হওয়া দরকার। তাই নতুন পদ্ধতিকে তিনি স্বাগত জানান। প্রবীণ অঙ্কোলজিস্ট সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, যে কোনও নতুন পদ্ধতির ভাল ও মন্দ, দু’দিকই রয়েছে। তবে নীতিগত ভাবে এটা ঠিক। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হওয়া সহজ নয়। তার জন্য কয়েক বার ফেল করলে ক্ষতি নেই। এমডি, এমএস-এ গ্রেস নম্বর দেওয়া অনুচিত।
চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘নতুন পদ্ধতিতে একপেশে মূল্যায়ন কমবে। বিদেশে গ্রেস মার্কস নেই। এখানে হোম সেন্টারে গ্রেস নম্বর দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন বিভাগীয় প্রধান বা প্রধান পরীক্ষকই। হোম সেন্টারে খাতা দেখা হলে নম্বর দেওয়ায় এক্সটারনােলর উপরেও ইন্টারনাল পরীক্ষকদের চাপ থেকে যায়। নতুন পদ্ধতিতে সেটা হবে না।’’