Azad Hind Government

বাঙালির নেতাজি-আবেগ ছুঁতেই কি আর এক ‘অকাল বোধনে’ বিজেপি? বাড়ছে তর্ক

‘‘নেতাজি সুভাষের নেতৃত্বাধীন সেই সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল বিশ্বের ১০টা দেশ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, স্বাধীন ভারতের কোনও সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে নেতাজির সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। আমাদের সরকার দিল।’’ বললেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৮ ১৮:২৮
Share:

গ্রাফিক- তিয়াসা দাস।

সদ্য শেষ হয়েছে অকাল বোধনের উৎসব। মহনগরীর গায়ে এখনও উৎসবের ঈষৎ রেশ লেগে। তার মাঝেই আর এক ‘অকাল বোধনে’ বিজেপি। দেশের সরকার এবং দেশের প্রধান শাসক দল রবিবার ভারত জুড়ে ‘বোধন’ ঘটাল জাতীয় পতাকার। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই প্রথম বার ১৫ অগস্ট ছাড়া অন্য কোনও তারিখে লালকেল্লার প্রাকারে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। আর পূর্ণ উদ্যমে গোটা বাংলায় জাতীয় পতাকা তুলে ‘আজাদ হিন্দ সরকার’ প্রতিষ্ঠার প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী পালন করল বিজেপি।

Advertisement

১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়েছিল। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সেই সরকারের প্রধান হয়েছিলেন। সেই সরকারের হাতে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ তুলে দিয়েছিলেন জাপানরাজ। সেই সরকারের নেতৃত্বেই ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’ (আইএনএ) উত্তর-পূর্ব ভারতের একাংশে সাময়িক ভাবে পিছু হঠতে বাধ্য করেছিল ব্রিটিশ ফৌজকে।

‘‘নেতাজি সুভাষের নেতৃত্বাধীন সেই সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল বিশ্বের ১০টা দেশ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, স্বাধীন ভারতের কোনও সরকার আনুষ্ঠানিক ভাবে নেতাজির সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। আমাদের সরকার দিল।’’ বললেন রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ। শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে রবিবার সকালে নেতাজির মূর্তিতে পুষ্পার্ঘ দিয়েছেন দিলীপবাবু। এলগিন রোডে নেতাজির পৈতৃক বাসভবনে গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিজেপির জাতীয় সম্পাদক রাহুল সিংহ। আইএনএ প্রতিষ্ঠার আর এক প্রধান কারিগর রাসবিহারী বসুর মূর্তিতে মালা দিয়েছেন রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু। চন্দনগরের সেই অনুষ্ঠানে আবার আজাদ হিন্দ সরকারের পতাকা উত্তোলন করেছেন সায়ন্তন। বাংলার প্রতিটি জেলায় বিজেপি কার্যালয়ে এ দিন জাতীয় পতাকা উঠেছে। অন্যান্য রাজ্যেও বিজেপি পালন করেছে আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠার ৭৫ বছর।

Advertisement

নেতাজি সুভাষকে নিয়ে বিজেপির তথা কেন্দ্রীয় সরকারের এই তৎপরতা কি শুধুই রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা থেকে? নাকি আসন্ন লোকসভা ভোটের দিকে তাকিয়েই নেতাজিকে ঘিরে এই তৎপরতা?

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তিতে মাল্যদান করছেন বিজেপির জাতীয় সম্পাদক রাহুল সিনহা। নিজস্ব চিত্র।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, এক ঢিলে জোড়া শিকারের কৌশল নিয়েছে বিজেপি। প্রথমত, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এমন একটা ব্র্যান্ড, যাঁকে খুব সহজেই নেহরু-গাঁধী রাজের পাল্টা মেরু হিসেবে খাড়া করা যায়, মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রবিবার লালকেল্লার প্রাকার থেকে যে ভাষণ দিয়েছেন, তাতেও ওই ‘পাল্টা মেরু’ তৈরির চেষ্টা পরিষ্কার। শুধুমাত্র একটা পরিবারের স্বার্থে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের অবদান ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন মোদী। দ্বিতীয়ত, নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে ঘিরে বাঙালির আবেগ আজও উত্তুঙ্গ। বাঙালির সেই আবেগে সওয়ার হতে চাইছে বিজেপি। তাই বাংলার বিজেপি নেতৃত্ব সবচেয়ে জোর দিয়ে উদযাপন করেছে আজাদ হিন্দ সরকারের ৭৫ বছর।

২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত, রাজস্থানে অভূতপূর্ব ফলাফল করেছিল বিজেপি। লোকসভায় প্রথম বার বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের কারিগর মূলত ওই রাজ্যগুলোই। আগামী লোকসভা নির্বাচনে ওই রাজ্যগুলোর সবকটাতেই বিজেপির আসন কমবে বলে আভাস মিলতে শুরু করেছে নানা ছোটখাটো নির্বাচনে এবং জনমত সমীক্ষায়।

রাসবিহারী বসুর মূর্তিতে মাল্যদান করছেন রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু। নিজস্ব চিত্র।

গোবলয়ের ক্ষতি কিছুটা যাতে পুষিয়ে নেওয়া যায় পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে, তা নিশ্চিত করতে মোদী-শাহ জুটি এখন অত্যন্ত তৎপর। আর সেই লক্ষ্য পূরণে জুটির মূল নিশানা এখন বাংলা— বলছেন রাজ্যের বিজেপি নেতারাই। লালকেল্লার প্রাকারে প্রথম বার প্রধানমন্ত্রীর হাতে জাতীয় পতাকার ‘অকাল বোধন’ এবং সেই ‘অকাল বোধন’ এক বাঙালির জন্য— এই দৃশ্য তৈরি করে মোদী-শাহ জুটি আসলে নিজেদের সাংগঠনিক লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছতে চাইছেন, তা বুঝতে কারওরই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়— বলছেন বিরোধী দলগুলির নেতা-নেত্রীরা।

আরও পড়ুন: রণসজ্জা শেষ, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বিক্রমাদিত্য

দিলীপ ঘোষ অবশ্য ‘রাজনৈতিক অভিসন্ধি’র তত্ত্ব সপাটে নস্যাৎ করছেন। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘যাঁরা এ সব কথা বলছেন, তাঁরা নিজেরা দিনটা পালন করলেন না কেন? আজাদ হিন্দ সরকারের ৭৫ বছর দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সন্ধিক্ষণ। আমাদের সরকার এবং আমাদের দল সেই দিনটা উদযাপন করছে। বাকিরাও উদযাপন করলেই পারতেন। বুঝতাম নেতাজি সুভাষচন্দ্রের অবদান সম্পর্কে তাঁরাও শ্রদ্ধাশীল।’’

আরও পড়ুন: ‘একটি পরিবারকে তুলে ধরতেই নেতাজিকে উপেক্ষা করেছে কংগ্রেস’

আর সায়ন্তন বসু বললেন, ‘‘যে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আজ বলছেন যে, গোবলয়ের ক্ষতি বাংলায় পুষিয়ে নেওয়ার জন্যই নেতাজিকে নিয়ে আমাদের হইচই, তাঁদের উদ্দেশে আমার একটা প্রশ্ন রয়েছে।’’ কী প্রশ্ন? ‘‘শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৫১ সালের যে তারিখে ভারতীয় জনসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটাও ২১ অক্টোবরই ছিল। আজাদ হিন্দ সরকারের প্রতিষ্ঠা দিবস বলেই ওই তারিখটা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বেছে নিয়েছিলেন দল প্রতিষ্ঠার জন্য। সে দিন কোন বলয়ের ক্ষতি কোন অঞ্চল থেকে পুষিয়ে নেওয়ার কথা মাথায় রেখে শ্যামাপ্রসাদ ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা যদি আমাকে কেউ বুঝিয়ে দেন, খুশি হব।’’

(বাংলার রাজনীতি, বাংলার শিক্ষা, বাংলার অর্থনীতি, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার স্বাস্থ্য, বাংলার আবহাওয়া -পশ্চিমবঙ্গের সব টাটকা খবর আমাদের রাজ্য বিভাগে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন