পাড়ুই হত্যা-মামলায় বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের নির্দেশেরই পুনরাবৃত্তি হল কলকাতা হাইকোর্টে। ঘটনার তদন্তে রাজ্যের গড়ে দেওয়া বিশেষ দল (সিট)-এর প্রধান তথা রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে আদালতে তলব করলেন বিচারপতি হরিশ টন্ডন-ও। মাঝে গড়িয়ে গেল চার-চারটি মাস। ডিজি’র হাজিরা রুখতে রাজ্য সরকার এ বারও ডিভিশন বেঞ্চে যাবে কি না, তা স্পষ্ট নয়।
পাড়ুই-কাণ্ডে সিটের অবস্থান জানতে ডিজি জিএমপি রেড্ডিকে তলব করেছিলেন বিচারপতি দত্ত। সেটা গত ১০ এপ্রিলের ঘটনা। ডিভিশন বেঞ্চের স্থগিতাদেশের সুবাদে ডিজি সে যাত্রায় ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে রেহাই পেয়ে যান। কিন্তু মঙ্গলবার ওই মামলায় ফের ডিজি’কেই ডেকে পাঠাল হাইকোর্ট। মাঝের চার মাসে মামলাটি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ-সুপ্রিম কোর্ট-বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের আদালত হয়ে ঘুরে এসেছে বিচারপতি টন্ডনের এজলাসে।
এবং বিচারপতি দত্তের মতো বিচারপতি টন্ডনও সিট-তদন্তের রকম-সকম দেখে খুশি হতে পারেননি। ইতিমধ্যে তিনিও প্রশাসনের কাছে জানতে চেয়েছেন, মামলায় প্রধান অভিযুক্ত অনুব্রত মণ্ডলকে (তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি) কেন ধরা গেল না? “সিট আরও সক্রিয় হয়ে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে পারত। তা করেনি।” সিটের রিপোর্ট পড়ে মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
আদালতের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ এ দিনও দেখা গিয়েছে। প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য ডিজি’কে এজলাসে ডেকে পাঠিয়েছেন বিচারপতি টন্ডন-ও। তাঁর কথায়, “হাইকোর্টের নির্দেশে সিট গড়া হয়েছিল। হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে তদন্ত চলছিল। এমতাবস্থায় সিট হাইকোর্টের অনুমতি ছাড়া কী ভাবে নিম্ন আদালতে মামলার চার্জশিট জমা দিল, সিটের প্রধান হিসেবে ডিজি-কে আদালতে এসে তা ব্যাখ্যা করতে হবে।” প্রথমে ২৮ অগস্ট ডিজি’র হাজিরার দিন স্থির করে দিয়েছিলেন বিচারপতি। রাজ্যের কৌঁসুলি কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘একটু সময়’ চাইলে বিচারপতি নির্দেশ পরিমার্জন করে জানান, ডিজি-কে ৪ সেপ্টেম্বর কোর্টে হাজির হতে হবে।
বস্তুত এ দিন শুনানি শুরুতেই পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মনজিৎ সিংহ আদালতকে জানিয়েছিলেন, সিটের তদন্ত শেষ হয়েছে। তাই ১৬ জুলাই সিট নিম্ন আদালতে মামলার চার্জশিট দাখিল করেছে। শুনে বিচারপতি টন্ডন জিজ্ঞাসা করেন, “এত তড়িঘড়ি চার্জশিট কেন? কেনই বা আমি ডিজি-র কাছে তা জানতে চাইব না?” পিপি জবাব দেন, “আমি মনে করি, চার্জশিট পেশ হওয়ার পরে আদালতের আর তদন্তে নজরদারি করা উচিত নয়।” কল্যাণবাবুও বলেন, “আরও তদন্ত দরকার কি না, তা নিম্ন আদালত ঠিক করতে পারে। তদন্তে নজরদারির কথা সুপ্রিম কোর্ট বলতে পারে। হাইকোর্ট পারে না।”
বিবাদীপক্ষের বক্তব্য বিচারপতি অবশ্য খারিজ করে দেন। “তদন্ত যথাযথ হচ্ছে কি না, সে দিকে নজর রাখা কোর্টের কাজ। তা ছাড়া মামলা এখন যে জায়গায়, সেখানে এ সব যুক্তি অর্থহীন।” জানিয়ে দেন তিনি। বিচারপতির মন্তব্য, “এই মামলা নিয়ে একাধিক নির্দেশ ইতিপূর্বে দেওয়া হয়েছে। হাইকোর্ট বহু আগে থেকে তদন্তে নজর রাখছে। যে ভাবে রাজ্য সিট’কে আড়াল করছে, তা দেখে আমি বিস্মিত।”
আদালতের এ হেন পর্যবেক্ষণের কথা শুনে কল্যাণবাবু দাবি করেন, দুই অভিযুক্তের জামিন ঠেকাতেই সিট চার্জশিট পেশ করেছে। অন্য দিকে শিবানীদেবীর কৌঁসুলি ফিরোজ এডুলজি সওয়ালে বলেন, শিবানী ঘোষ ও সরস্বতী ঘোষ (নিহতের স্ত্রী)-কে দিয়ে সাদা কাগজে সই করানোর অভিযোগে প্রশাসন দুই পুলিশ অফিসারকে সাসপেন্ড করলেও তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করেনি, তদন্তেও নামেনি। প্রসঙ্গত, বিচারপতি দত্তও পাড়ুই-তদন্তে রাজ্যের ভূমিকার সমালোচনা করে ১০ এপ্রিলের লিখিত নির্দেশে বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর আশীর্বাদধন্য হওয়ার সুবাদেই অনুব্রত সিটের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন!
২০১৩-র ২১ জুলাই, পঞ্চায়েত ভোটের আগের রাতে পাড়ুইয়ের কসবা গ্রামের বাঁধ নবগ্রামে খুন হন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলকর্মী সাগর ঘোষ, যাঁর ছেলে হৃদয় ঘোষ নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। পুত্রবধূ শিবানীদেবীর অভিযোগ ছিল, পুলিশ ওঁঁদের দিয়ে জবরদস্তি সাদা কাগজে সই করিয়ে নিয়েছে, এবং তাতে ক’জনের নাম লিখে তাদের গ্রেফতার করে আসল অপরাধীদের আড়াল করেছে। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে পুলিশ সাগর-হত্যার এফআইআর নেয়, যাতে অনুব্রতের পাশাপাশি বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীরও নাম আছে। অনুব্রত-বিকাশ এখনও অধরা। এ দিকে পুলিশ যাঁদের গ্রেফতার করেছিল, তাঁরা জামিন পেয়ে সিবিআই-তদন্তের আর্জি জানিয়ে হাইকোর্টে মামলা করেন। সাগরবাবুর পরিবার তাতে সামিল হয়। কোর্টে পরিজনদের দেওয়া জবানবন্দিতেও অভিযুক্ত-তালিকায় অনুব্রতের নাম এক নম্বরে।
এই অবস্থায় গত ১৪ ফেব্রুয়ারি পাড়ুই-তদন্তে বিশেষ দল (সিট) গড়ে দিয়ে হাইকোর্ট ডিজি’কে মূল তদন্তকারী নিযুক্ত করেছে। কিন্তু সিটের কাজকর্ম সম্পর্কে আদালত যেমন অসন্তুষ্ট, নিহতের পরিবারও খুশি নয়। হৃদয়বাবু আক্ষেপ করেন, “আমি বরাবরই নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছি। যাঁদের মূল ষড়যন্ত্রকারী চিহ্নিত করে আমার মা ও স্ত্রী ম্যাজিস্ট্রেটকে গোপন জবানবন্দি দিলেন, পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার তো দূর, জিজ্ঞাসাবাদই করল না!”
চার মাস আগে, দত্ত-নির্দেশের পর দিনই রাজ্য হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করে ডিজি’র ব্যক্তিগত হাজিরায় স্থগিতাদেশ পেয়েছিল। টন্ডন-নির্দেশ ঠেকাতেও কি তা-ই করবে?
রাজ্যের আইন ও বিচারমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, এখনও কিছু ঠিক হয়নি। যদিও হাইকোর্টের আইনজীবীদের একাংশের ধারণা, রাজ্য সরকারের ডিভিশন বেঞ্চে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা। কারণ, বর্তমান ডিজি জিএমপি রেড্ডি আদালতে মুখ খুললে মামলায় রাজ্য সরকার কিছুটা অসুবিধায় পড়তে পারে বলে ওঁরা মনে করছেন। হৃদয়বাবুর কৌঁসুলি শীর্ষেন্দু সিংহরায় অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, “রাজ্য ডিভিশন বেঞ্চে গেলে যাবে। বেঞ্চ অন্য নির্দেশ দিলে আমরা ফের সুপ্রিম কোর্টে যাব।” বিচারপতি টন্ডনের নির্দেশকে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়ে বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের প্রতিক্রিয়া, “হাইকোর্টের সঙ্গে চালাকির চেষ্টার উপযুক্ত জবাব সরকার পেয়েছে। এতে আইনের উপরে বিচারপ্রার্থীদের আস্থা বাড়বে।”