সরকারি হাসপাতালে নিখরচায় সব চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নির্বাচনী প্রচারে সরকারের অন্যতম ‘সাফল্য’ হিসেবে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতায় বারবার উঠে এসেছে সেই প্রসঙ্গ। স্বাস্থ্য দফতরের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর কথা রাখতে গিয়ে কার্যত নিয়ম-কানুন শিকেয় তুলে রাখছে হাসপাতালগুলি। অথচ বিনামূল্যে প্রাপ্য চিকিৎসাও পাচ্ছেন না অনেক রোগী।
কী ভাবে ঘটছে এমনটা?
• নিজেদের ব্যবস্থা না থাকায় কলকাতার একাধিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল যে সব বেসরকারি সংস্থা থেকে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাচ্ছে, তাদের বাছা হয়েছে দরপত্র ছাড়া, ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে। যা নিয়মবিরুদ্ধ।
• অনেক ক্ষেত্রেই রোগীকে নিজেদের পছন্দমতো জায়গায় পরীক্ষা করতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বা হাসপাতালের সুপার। অথচ যে ল্যাবরেটরিতে সেই পরীক্ষা হচ্ছে, তার যোগ্যতা ও গুণমান যাচাই করার কোনও সুযোগ থাকছে না।
• দরপত্র ছাড়াই যে ল্যাবরেটরিগুলিকে বাছা হয়েছে, তাদের অনেকেই বাজারচলতি দরের থেকে তিন গুণ বেশি টাকা নিচ্ছে। এবং তা মিটিয়েও দেওয়া হচ্ছে।
• একাধিক ল্যাবরেটরি আবার হাসপাতাল থেকে সংগ্রহ করা রোগীর রক্ত, থুতু, প্রস্রাবের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছে অন্য কোনও নামগোত্রহীন ল্যাবরেটরিতে। এদের বেশির ভাগের ঠিকানাই জানা নেই হাসপাতালের।
• নিজেদের পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। আবার কোনও ল্যাবরেটরির সঙ্গে চুক্তিও হয়নি। এই রকম কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল রোগীদের ফিরিয়ে দিচ্ছে। বাধ্য হয়ে তাঁরা বাইরে থেকে নিজেদের খরচে পরীক্ষা করাচ্ছেন।
অথচ, গত নভেম্বর মাসে রাজ্যের স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় নির্দেশ জারি করে জানিয়েছিলেন, হাসপাতালে সব কিছুর পরীক্ষা হয় না। তাই জরুরি ভিত্তিতে বাইরের কোনও ল্যাবরেটরি থেকে পরীক্ষার ব্যবস্থা করবে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল। এ জন্য রোগীরা কোনও খরচ দেবেন না। ল্যাবরেটরির টাকা মেটাবে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল। তবে এই ব্যবস্থা নিতান্তই অস্থায়ী। যত দ্রুত সম্ভব দরপত্রের ভিত্তিতে ল্যাবরেটরি বাছাই করে সেখান থেকে মেডিক্যাল কলেজগুলিকে প্রয়োজনীয় টেস্ট বা পরীক্ষা করিয়ে আনতে হবে।
ওই নির্দেশিকা জারির পর ছ’মাস কেটে গিয়েছে। এই সময়ে কোনও হাসপাতাল দরপত্র ডেকে ল্যাবরেটরি ঠিক করেনি। সবই হচ্ছে কর্তৃপক্ষের ঠিক করে দেওয়া ল্যাবরেটরিতে। এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রশ্ন করলে তাঁর জবাব, ‘‘যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে। স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশেই হচ্ছে।’’ এর পরেই তিনি যোগ করেন, ‘‘আপনারা স্বাস্থ্য দফতরের বিরুদ্ধে লিখবেন তো? লিখুন, লিখুন। শত লিখলেও পরের বার আমাদের সরকারই আসবে।’’
মুখে এ কথা বললেও ‘ভিজিল্যান্স’ নড়েচড়ে বসায় চিন্তার ভাঁজ পড়েছে স্বাস্থ্যকর্তাদের কপালে। সুশান্তবাবুর দফতর থেকে সব মেডিক্যাল কলেজে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, দ্রুত দরপত্র ডেকে ল্যাবরেটরি বাছাই করতে হবে। না হলে ভিজিল্যান্স-তদন্তের মুখে বিপদে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ সূত্রের খবর, গত ডিসেম্বর থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত দু’টি বেসরকারি ল্যাবরেটরি থেকে তারা বিভিন্ন পরীক্ষা করিয়েছে। এর মধ্যে একটি ল্যাবরেটরির সঙ্গে তাদের ‘রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা’ প্রকল্পে চুক্তি হয়েছিল। তাদের থেকে প্রায় ৬ লক্ষ টাকার পরীক্ষা করানো হয়েছে। চিকিৎসকরা অভিযোগ করেছেন, যে পরীক্ষা করাতে ৬ হাজার টাকার বেশি লাগার কথা নয়, তার জন্য ওই ল্যাবরেটরিকে দিতে হয়েছে ২১ হাজার টাকা। নিউরো মেডিসিনের যে পরীক্ষা ৭ হাজার টাকায় হতে পারে, তার জন্য ওই ল্যাবরেটরি নিয়েছে ২৯ হাজার টাকা। যে ল্যাবরেটরি থেকে মেডিক্যাল কলেজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাচ্ছে, তাদেরও দরপত্র ডেকে ঠিক করা হয়নি। অথচ গত ছ’মাসে এই ল্যাবরেটরির পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাবদ প্রায় ৪০ লক্ষ টাকার বিল জমা দিয়েছে। যিনি এই সংস্থাটিকে বাছাই করেছেন বলে হাসপাতাল সূত্রে খবর, মেডিক্যালের সেই সুপার শিখা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘এ ব্যাপারে মন্তব্য করব না। খুব তাড়াতাড়ি টেন্ডার ডাকা হচ্ছে।’’ ওই দুই ল্যাবরেটরির কর্তারাও এই নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
এসএসকেএম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আবার সরল স্বীকারোক্তি, সরকারের কোনও ‘গাইডলাইন’ না থাকায় তারা এখনও দরপত্র ডেকে ল্যাবরেটরি বা ডায়াগনস্টিক ক্লিনিক বাছাই করতে পারেননি। চিকিৎসকেরা যখন যা ঠিক মনে করেন, সেই ক্লিনিকেই রোগী পাঠান। আর তার পরীক্ষার গুণমান যাচাই না করেই টাকা মেটায় সরকার। আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ জানাচ্ছে, তারা এখনও দরপত্র ডেকে ল্যাবরেটরি বাছাই করতে পারেনি। তাই রোগীদের অনেক পরীক্ষাই বাইরে থেকে করাতে হচ্ছে। টাকা রোগীকেই মেটাতে হয়।
দরপত্র ডেকে ল্যাবরেটরি বাছাই করতে পারেনি ন্যাশনাল মেডিক্যাল এবং নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজও। রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব রাজেন্দ্র শুক্লর এ নিয়ে সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘‘পৃথিবীর অবস্থা এখন খুব জটিল। তাই কোনও মন্তব্য করব না।’’