স্থাপত্য আর ঐতিহ্যের বাহক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাওয়ালি

মেলা, সাহিত্যের ইতিহাস আর সিনেমা— এই তিনের নীরব সাক্ষী ঐতিহ্যের তিন দেবত্র সম্পত্তির। ‘বনে এলি গেলি’— এই কথা থেকে ‘বাওয়ালি’। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাওয়ালি রাজার হাজার হাজার জমি নিবেদিত হয়েছিল দেবত্র হিসাবে। তারাতলার মোড় ছুঁয়ে জিঞ্জিরাপোল ছুঁয়ে বজবজ ট্রাঙ্ক রোড-মহাত্মা গাঁধী রোড-চিড়িয়া মোড়-নিশ্চিন্দিপুর-গোবরঝুড়ি হয়ে বাওয়ালির মোড়।

Advertisement

অশোক সেনগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৫ ১৭:৪১
Share:

বাওয়ালি রাজপরিবার

মেলা, সাহিত্যের ইতিহাস আর সিনেমা— এই তিনের নীরব সাক্ষী ঐতিহ্যের তিন দেবত্র সম্পত্তির।

Advertisement

‘বনে এলি গেলি’— এই কথা থেকে ‘বাওয়ালি’। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাওয়ালি রাজার হাজার হাজার জমি নিবেদিত হয়েছিল দেবত্র হিসাবে। তারাতলার মোড় ছুঁয়ে জিঞ্জিরাপোল ছুঁয়ে বজবজ ট্রাঙ্ক রোড-মহাত্মা গাঁধী রোড-চিড়িয়া মোড়-নিশ্চিন্দিপুর-গোবরঝুড়ি হয়ে বাওয়ালির মোড়। এর পর বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে প্রাসাদ আর একগুচ্ছ মন্দির। এর বেশির ভাগটাই দেবত্র। গিয়ে দেখা গেল, বেসরকারি ছোঁয়ায় প্রাসাদের ভোল বদলাচ্ছে। কিন্তু দীর্ঘ অবহেলায় কিছু মন্দিরের হাল খুব খারাপ। গোবিন্দজী এবং লক্ষ্মী-জনার্দনের মন্দির, দ্বাদশ শিবমন্দির— প্রতিটিতে প্রাচীন স্থাপত্যের ছাপ। পরিবারের প্রবীণ সদস্য অরুণ মণ্ডল বলেন, ‘‘যতটা সম্ভব দেবস্থান বাঁচানোর চেষ্টা করছি।’’ পালাপার্বণে কেবল ক’দিনের জন্য জেগে ওঠে বাওয়ালির এই রাজবাড়ির মন্দির।

দক্ষিণ কলকাতায় ৮০ টালিগঞ্জ রোডে রয়েছে বাওয়ালিদের বড় রাসমন্দির, ৫৫ টালিগঞ্জ রোডে ছোট রাসমন্দির। দুই বাড়িতে অবশ্য প্রতি বছর পুজো হয়। প্রথমটিতে কার্তিক পুজো, দ্বিতীয়টিতে চৈত্র পুজো হয়। তিন দিন ধরে মেলা বসে। বাংলা ১২২৩ সালের ফাল্গুন মাসে কৃষ্ণ একাদশীর দিন টালিগঞ্জে বর্তমান দ্বাদশ মন্দিরের মাঝখানে সাজানো চিতায় বংশের এক পূর্বপুরুষ মানিক মণ্ডলের স্ত্রী সহমৃতা হয়েছিলেন। সতী মুক্তকেশীর শাখা-সিঁদুর এখনও রয়েছে টালিগঞ্জে বাওয়ালিদের বাড়িতে। আদিগঙ্গার ধারে এককালে গৃহদেবতার নামে তৈরি হয়েছিল গঙ্গাগোবিন্দের ঘাট, গোপালজীর ঘাট। স্থানীয় হাজার রকম লোক এই সব ঘাট ব্যবহার করছে।

Advertisement

ভদ্রেশ্বরে তেলেনিপাড়ার জমিদারবাড়ির সাবেক বিপুল সম্পত্তির একটা বড় অংশ দেবত্র। প্রায় ১৬৫ বছর আগে এই জমিদারবাড়িতেই আশ্রয় নেন উচ্চাভিলাষী এক লেখক। লিখতে শুরু করেন। ১৮০০-তে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে একটু একটু করে শুরু হয়েছিল বাংলা গদ্যচর্চা। কিন্তু ১৮৫৭-তে প্রকাশ হল তেলেনিপাড়ার জমিদারবাড়িতে বসে সেই লেখা বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’। কিন্তু এ কী! এ যে ওই জমিদারদেরই কেচ্ছার কৌশলি প্রকাশ! প্রায় ধমকে, ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বহিষ্কার করে দেওয়া হল ৪৩ বছর বয়সী সেই লেখক প্যারিচাঁদ মিত্র ওরফে টেকচাঁদ ঠাকুরকে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে গেল সেই কালজয়ী লেখা!

ভদ্রেশ্বর রাজবাড়ীর ফলক

এখন কেমন আছে ব্যানার্জিদের সেই জমিদারবাড়ি?

গঙ্গা বেশ কিছুটা দূরে সরে গিয়েছে। সুন্দর, প্রাচীন স্থাপত্যের জমিদারবাড়ি বহন করে চলেছে দেবত্রের বোঝা। অদূরেই মন্দির। তাতে রূপোর শিব, অষ্টধাতুর অন্নপূর্ণা। প্রবেশপথের পাশে এবং ভিতরের দেওয়ালে শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা বাংলা ১২০৮-এ প্রতিষ্ঠা। সঙ্গে খোদাই ‘প্রতিষ্ঠাতা বর্গীয় জমিদার বৈদ্যনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়’। দু’টি হাড়িকাঠ। একটি মোষের, অন্যটি পাঁঠার। পশুবলি বন্ধ হয়ে গেলেও ওগুলো রয়ে গিয়েছে অতীতের ঐতিহ্য হিসাবে। পুজোয় অবশ্য ও দু’টো পূজিত হয়। সিঁদুর চড়ে হাড়িকাঠে।

আন্দুল রাজবাড়ী

আন্দুলে অবহেলায় প্রায় ১৮৫ বছরের প্রাচীন, অনুপম স্থাপত্যের রাজবাড়ি। ১৯৬২ সালে মীনা কুমারি, ওয়াহিদা রহমান অভিনীত ‘সাহেব বিবি আউর গুলাম’ তৈরির জন্য গুরু দত্তর টিম দীর্ঘদিন শুটিং করেছিল এখানে। সম্পত্তির একটা বড় অংশ লিখে দেওয়া হয়েছিল গৃহদেবতার নামে। রাজবাড়ির অন্যতম মালিক এবং দেবত্র সম্পত্তির সেবায়েত অরুণাভ মিত্র এ কথা জানিয়ে বলেন, ‘‘টলিউড, টেলিফিল্ম, বিজ্ঞাপনের ছবি বিস্তর হয়েছে এই রাজবাড়িতে। শুটিং করেছেন স্বয়ং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।’’

মূল রাজবাড়ির পাশে দেওয়ালঘেরা অন্নপূর্ণার মন্দির। দুপুরে বন্ধ থাকে। খোলে ৫টার পর। চত্বরের দু’পাশে সাতটি করে, মোট ১৪টি শিবমন্দির। উঠোনে প্রাচীন ছোট কামান। অষ্টধাতুর মূর্তি ছিল মন্দিরে। প্রায় ৩৩ বছর আগে চুরি হয়ে যায়। পরে পাথর আর সামান্য অষ্টধাতু দিয়ে তৈরি হয় মূর্তি। মন্দিরগুলোয় এখনও পুজো হয়।

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন