দেবীপক্ষ জুড়ে রাজ্যে বধূ বিসর্জন পালা

বিসর্জনের লম্বা লাইন। তবে সে লাইনে নানা রূপে উমা দাঁড়িয়ে নেই। বরং আজও রয়েছেন রবি ঠাকুরের ‘দেনাপাওনা’ গল্পের নিরুপমারা।

Advertisement

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০১৬ ০৪:০৭
Share:

বিসর্জনের লম্বা লাইন। তবে সে লাইনে নানা রূপে উমা দাঁড়িয়ে নেই। বরং আজও রয়েছেন রবি ঠাকুরের ‘দেনাপাওনা’ গল্পের নিরুপমারা।

Advertisement

এক ঘাটে যেমন প্রশাসনের খাতায় উঠছে প্রতিমা নিরঞ্জনের খতিয়ান, তেমন আর এক ঘাটে অন্য এই ‘বিসর্জনের’ হিসেব রাখছেন অসংখ্য রামসুন্দর মিত্র। নিরুপমাদের অসহায় বাবা-রা।

শারদোৎসবের উজ্বল দিনগুলো বর্ণহীন হয়েছে একাধিক বধূমৃত্যু ও নারী নিগ্রহের ঘটনায়।

Advertisement

পুলিশ-সূত্রের খবর: মহালয়ার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে অন্তত ছ’জন মহিলা অস্বাভাবিক ভাবে মারা গিয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ের হয়েছে বধূ নির্যাতনের নালিশ। পাশাপাশি মেমারিতে ঘটেছে গণধর্ষণ। মুর্শিদাবাদে স্বামীকে ছেড়ে যাওয়ার ‘অপরাধে’ সালিশিসভায় বধূকে ১০৮ বার কঞ্চির বাড়ি মেরে চুল কেটে নেওয়া হয়েছে।

এ সবের মধ্যেই ইঙ্গিত মিলেছে, এখনও ‘রায়বাহাদুর’দের অভাব নেই। তাই পণের দাবি মেটাতে না-পারায় যাদবপুরের প্রাক্তন ছাত্রী মিতা মণ্ডলের প্রাণ গিয়েছে দশমীর ভোরে, উলুবেড়িয়ার শ্বশুরবাড়িতে। বাবা সহদেব দাসের অভিযোগ ক’দিন আগে গড়িয়া শান্তিনগরে বাপের বাড়ি এসে মেয়ে এক লাখ টাকা চেয়েছিল। বাবা অপারগ শুনে মুখ কালো করে চলে যায়। দু’দিন বাদে বাবা-মা খবর পেয়ে ছুটে গিয়ে দেখেছেন চব্বিশ বছরের মেয়ের নিথর দেহ। জামাই বারবার বোঝাতে চেয়েছে, আত্মহত্যা। ওঁরা মানেননি। অভিযোগ পেয়ে মিতার স্বামী রানা মণ্ডল ও আর এক জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

এক-একটা মৃত্যু অনেক মানুষকে জাগিয়ে দিয়ে যায়। যেমন দিয়েছেন তিলজলার নাজিয়া ফাইজা। নিজে পুড়েছেন, কিন্তু সেই আগুনে তামাম তপসিয়া জ্বলে উঠেছে।

বছর পাঁচেক আগে নাজিয়ার বিয়ে হয়েছিল রিন্টুর সঙ্গে। মা শামিম বানুর অভিযোগ— শ্বশুরবাড়িতে নানা অজুহাতে মেয়ের উপরে নির্যাতন চলতো। পুলিশকে জানিয়েও আইনি সাহায্য মেলেনি। শেষমেশ শুক্রবার দুপুরে দু’বছরের ছেলে ও ছ’মাসের মেয়েকে পাশের ঘরে আটকে রেখে নাজিয়ার গায়ে আগুন লাগানো হয়। ন্যাশনাল মেডিক্যালে স্ত্রীর দগ্ধ দেহ ফেলে রেখে চম্পট দেয় রিন্টু। তাকে পুলিশ ধরলেও দুই বাচ্চাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোক নিখোঁজ।

শামিমার লড়াইয়ে পাশে রয়েছেন পড়শিরা। দোষী সকলকে গ্রেফতারের দাবিতে শনিবার তিলজলায় পথ অবরোধ হয়। আবার মিতার ‘খুনি’দের শাস্তি চেয়ে রবিবার গড়িয়ার শান্তিনগরে মিছিল বেরিয়েছে। ঝড় উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। দোষীদের কঠোর সাজা চেয়ে কয়েকটি সংগঠন অনলাইনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আবেদন পাঠিয়েছে।

একই ভাবে বারুইপুরের নমিতা নস্কর, রিষড়ার পায়েল পাল ও তমলুকের আলেমারা বিবির আত্মীয়-পরিজনেরা প্রতিকার চেয়ে লড়ছেন। প্রতি ক্ষেত্রেই শ্বশুরবাড়ির তরফে দাবি: বাড়ির বৌ আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু মৃতার পরিবার তো বটেই, বা পাড়া-পড়শিদের অনেকেও দাবিটা মানতে নারাজ।

কী রকম? যেমন নমিতার পরিবারের অভিযোগ, শুক্রবার গভীর রাতে তাদের মেয়েকে বিষ খাইয়ে মেরেছে স্বামী ভাস্কর নস্কর। পায়েলের ঝুলন্ত দেহ পাওয়া যায় পঞ্চমীর সকালে, শ্বশুরবাড়ির বাথরুমে। প্রাথমিক ভাবে পুলিশেরও মনে হয়েছিল এটা আত্মহত্যা। তবে হাসপাতালের ডাক্তারেরা জানান, মৃত্যু হয়েছে অনেক আগে।

পায়েলের মা নমিতা হাজরা খুনের মামলা রুজু করেছেন। তাঁর অভিযোগ— এক সহকর্মীর সঙ্গে জামাই কৃষ্ণেন্দুর ‘অবৈধ সম্পর্ক’ নিয়ে মেয়ে আপত্তি তুলতেই অশান্তি তুঙ্গে ওঠে। আগেও টাকার জন্য, কখনও বা বিনা কারণে পায়েলকে শ্বশুরবাড়ির বিস্তর গঞ্জনা শুনতে হতো বলে আক্ষেপ করছেন মা। রবিবার সকালে উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে এক মহিলার বিবস্ত্র দেহ মিলেছে। পুলিশের প্রাথমিক অনুমান, রত্না বর্মন (৩৫) নামে বধূটিকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে। স্বামী ঝন্টু বর্মন পলাতক।

‘বধূ বিসর্জন’ পর্বের কি তবে সত্যিই অন্ত নেই?

মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যাল মনে করেন, নিছক আইন বা প্রশাসনের হাত ধরে প্রতিকার পাওয়া মুশিকল। সর্বাগ্রে চাই উপযুক্ত প্রতিবাদ ও নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার তাগিদ। ‘‘মানসিক দিক থেকে শিক্ষিত না-হলে এ জাতীয় অত্যাচারের প্রবণতা আসে,’’ অভিমত নীলাঞ্জনাদেবীর। তাঁর কথায়, ‘‘পণপ্রথার সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির আর্থিক সঙ্গতির সম্পর্ক নেই। প্রথম দিনেই বৌকে বুঝিয়ে দিতে হবে, তার আলাদা অস্তিত্ব আছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে সঙ্গে সঙ্গে।’’ সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিৎ মিত্রও একমত। তাঁর পর্যবেক্ষণ— ‘‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে মেয়েরা রুখে দাঁড়ান। আইন বা পুলিশের আগে নিজেদের তরফে প্রতিবাদটা সবচেয়ে জরুরি। চারপাশের মানুষদেরও সচেতন হতে হবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement