কেউ দিলেন, কেউ পারলেন না মনোনয়ন জমা দিতে

দ্বিতীয় দিনেও চলল মারধর

গোটা ঘটনাটি ঘটে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে। তবে কী করে অভিযোগ অস্বীকার করছে শাসকদল? ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, “বিলাস লক্ষ্মণের মনোনয়ন পত্র দাখিল হয়ে গিয়েছিল। তারপর এই ঘটনা।

Advertisement

নিজস্ব  প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৪ এপ্রিল ২০১৮ ০২:০১
Share:

তাণ্ডব: খানাকুলের বিজেপির জেলা পরিষদ প্রার্থী সুব্রত রাণাকে মার তৃণমূল কর্মীদের। মঙ্গলবার আরামবাগ মহকুমাশাসকের অফিসে। ছবি: মোহন দাস

ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছাড়িয়ে এগিয়েছে খানিকটা। হঠাৎ হইহই শব্দে চমকে উঠলেন আরামবাগ মহকুমাশাসকের অফিসের কর্মীরা। দফতরের দোতলায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের ঘরের সামনে তখন জামার কলার ধরে টেনে নীচে নামানোর চেষ্টা চলছে খানাকুলে বিজেপির জেলা পরিষদ প্রার্থী বিলাস লক্ষ্মণ ও তাঁর প্রস্তাবক তপন মণ্ডলকে। টানাটানিতে হাত ফসকে বিলাসবাবু ফের ঢুকে গেলেন ম্যাজিস্ট্রেটের ঘরে। কপাল মন্দ তপনবাবু। তাঁকে নামানো হল নীচে। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দেবব্রত রায় নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে কিছুটা ধাওয়া করলেও আটকাতে পারেননি। ততক্ষণে তপনবাবুকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পাশের আদালত চত্বরে। সেখানে ‘গণধোলাই’ দিয়ে খানিক বাদে ছেড়ে দেওয়া হয় তাঁকে।

Advertisement

পরে তপনবাবু বলেন, “কেন প্রার্থী দেওয়া হল প্রশ্ন তুলে নৈসরাইয়ের তৃণমূল যুব নেতা মীর চঞ্চল এবং তার লোকজন জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে মেরেছে।” সে অভিযোগ অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন মীর চঞ্চল। তাঁর দাবি, ‘‘তপনের কাছ থেকে আলু ব্যবসা বাবদ লক্ষাধিক টাকা পাই। ফেরত চাইলে সে আমাকে মারে। আমিও প্রতিবাদ করেছি।” আরামবাগ তৃণমূল ব্লক সভাপতি স্বপন নন্দী আবার বলেন, “এ সব ঘটনায় দলের কোনও যোগ নেই। ব্যক্তিগত পুরনো দেনা-পাওনা নিয়ে ঝামেলা হয়েছে।”

গোটা ঘটনাটি ঘটে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে। তবে কী করে অভিযোগ অস্বীকার করছে শাসকদল? ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, “বিলাস লক্ষ্মণের মনোনয়ন পত্র দাখিল হয়ে গিয়েছিল। তারপর এই ঘটনা। বিষয়টা মহকুমাশাসককে জানিয়েছি।”

Advertisement

যদিও সমস্যা এখানেই শেষ নয়। দুপুর ১টা নাগাদ ফের খানাকুলের আর এক বিজেপি প্রার্থী সুব্রত রানা মনোনয়ন পত্র দাখিল করেন। সিঁড়ি দিয়ে একতলায় নামতেই তাঁর ঘাড় ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয় জুবিলি পার্ক সংলগ্ন রাস্তায়। সেখানে মারধর করা হয়। অভিযোগ সেই তৃণমূলেরই বিরুদ্ধে।

মনোনয়ন তোলা বা জমা দেওয়ার দ্বিতীয় দিন— ছবিটা বদলাতে দিল না শাসকদল। বিরোধী দলের যে সব প্রার্থী বিডিও অফিসে গিয়েছিলেন মনোনয়ন জমা দিতে, অভিযোগ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের মারধর করা হয়েছে। বাদ যায়নি গালাগালিও। এমনকী বন্ধ হয়ে যাওয়া এক ভুয়ো অর্থলগ্নি সংস্থার অফিস খুলিয়ে বিডিও অফিস পাহারা দিতে বসছেন শাসকদলের কর্মীরা, সে অভিযোগও এসেছে হুগলি জেলা থেকে। মহকুমাশাসকের অফিসও বাদ পড়েনি শাসকের ঘেরাও থেকে।

খানাকুলের বিজেপি ব্লক সভাপতি বাবলু পাত্রের অভিযোগ, “ব্লকগুলি অফিসগুলিতে কোনও নিরাপত্তা নেই। মহকুমাশাসকের অফিসেও এই হাল! মানুষই বুঝে দেখুন শাসক কী হাল করেছে প্রশাসনের।” খানাকুলের সিপিএম জেনাল নেতা ভজহরি ভুঁইয়ার বলেন, “তৃণমূলের তো নাকি কত উন্নয়ন! তা হলে ভোট করাতে এত ভয় কেন? প্রশাসনকেই বা কেন ঠুঁটো করে রাখছে!”

একই চিত্র পান্ডুয়াতেও। বেলা ১ নাগাদ পান্ডুয়া বিডিও অফিসের মনোনয়ন দাখিল করতে আসেন বেশ কয়েকজন বিজেপি প্রার্থী। অভিযোগ, অফিসের ভিতরেই তৃণমূলের জয়হিন্দ বাহিনীর সভাপতি সঞ্চয় ঘোষের নেতৃত্বে তৃণমূলের কর্মীরা তাঁদের গালাগালি দিতে শুরু করেন। মারধরও করা হয়েছে বলে অভিযোগ। দীপঙ্কর রাজ ও অভিজিৎ ঘোষ নামে দুই বিজেপি প্রার্থী মনোনয়ন জমা দিতে পারলেও। অন্য ন’জন পারেননি।

সঞ্চয় ঘোষ অভিযোগ উড়িয়ে বলেন, ‘‘আমাদের দলের কাজের জন্য বিডিও অফিসে গিয়েছিলাম। এমন কিছুই হয়নি। বিজেপি মিথ্যা বলছে।’’ পান্ডুয়ার বিডিও সমীরণ অবশ্য ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ঘটনাটি আমার নজরে আসা মাত্রই পুলিশকে বলেছি ব্যবস্থা নিতে। পুলিশ সবাইকে অফিস চত্বরের বাইরে বের করে দেয়।’’

সোমবার গোঘাট বিডিও অফিসে মনোনয়নপত্র তুলতে গেলে মারধর করা হয় সন্তোষ পণ্ডিত নামে এক সিপিএম কর্মীকে। তিনি মনোনয়ন তুলতে পারেননি। আবার হরিপাল বিডিও অফিস লাগোয়া একটি অর্থলগ্নি সংস্থার অফিস রয়েছে দীর্ঘদিন বন্ধ পড়ে। সিপিএমের অভিযোগ, তৃণমূলের কর্মীরা ওই অফিসটি খুলে সোমবার থেকে সেখানে বসতে শুরু করেছেন। সিপিএমের কর্মী সমর্থকেরা বিডিও অফিসে গেলেই তাঁদের মারধর করে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সিপিএমের জেলা সম্পাদক দেবব্রত ঘোষ বলেন, “আমরা এই দু’টি ঘটনাই রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছি। আমাদের আশা কমিশন নিশ্চয় পদক্ষেপ করবে।”

সিপিআই এমএলের রাজ্য নেতৃত্ব ইতিমধ্যেই রাজ্য নির্বাচন কমিশনার অমরেন্দ্র কুমার সিংহকে স্মারকলিপি দিয়েছেন। মঙ্গলবার চুঁচুড়ার ঘড়ির মোড় থেকে মুখে কালো কাপড় বেঁধে লিবারেশনের কর্মীরা সদর মহকুমাশাসককে স্মারকলিপি দেন। সোমবার লিবারেশনের কর্মীদের মারধরের অভিযোগ উঠেছিল ধনেখালিতে।

সূত্রের খবর, বিরোধীশূন্য হিসাবে গত পঞ্চায়েত ভোট অনেকগুলি আসন জিতেছিল তৃণমূল। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অন্য ভাবে ঘুঁটি সাজাতে চাইছে সিপিএম। জেলার কয়েকটি ব্লক চিহ্নিত করে সরাসরি মহকুমাশাসকরের অফিসে মনোনয়নপত্র জমা দিতে প্রশাসনের কাছে আবেদন করছেন নেতৃত্ব। ধনেখালি, জাঙ্গিপাড়া, খানাকুল, তারকেশ্বর, গোঘাটের মত ব্লকগুলিতে অতীতেও মনোনয়ন জমা দেওয়া নিয়ে শাসকের কাছে মার খেতে হয়েছে বিরোধীদের।

দলের জেলা সম্পাদক দেবব্রত ঘোষ বলেন,“হুগলির কয়েকটি ব্লক উত্তেজনা প্রবণ। সংঘর্ষ এড়াতে আমরা বিডিও নয়, সরাসরি এসডিও অফিসে মনোনয়ন জমা দেওয়ার পক্ষে।’’ সিপিআইএমএল-এর রাজ্য কমিটির সদস্য সজল অধিকারীও বলেন,“পঞ্চায়েত নির্বাচনের আইনের ৪৬ ধারায় অধিকার দেওয়া হয়েছে, যে ক্ষেত্রে বিডিও অফিসে সমস্যা হবে সেক্ষেত্রে আমরা সরাসরি এসডিও অফিসে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারি। আমরা ইতিমধ্যেই সেই আবেদন করেছি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন