উত্তপ্ত: ভাঙচুরের পর জুটমিলের গেট সংলগ্ন তৃণমূলের কার্যালয়। ছবি: সুব্রত জানা
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পাল্টে গেল ছবিটা।
সকালে জুটমিলে কাজ বন্ধের (সাসপেনশন অব ওয়ার্ক) নোটিস। তার জেরে দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কড়া প্রতিক্রিয়া। তারপরে সন্ধ্যায় ফের জুটমিল খোলার নোটিস!—বুধবার এ সবই হল গোন্দলপাড়া জুটমিলকে ঘিরে।
এর মধ্যে অশান্তিও বাদ গেল না। সকালে জুটমিলের গেটে ওই নোটিস দেখার পরে উত্তাল হয়ে ওঠে শ্রমিক মহল্লা। সেখানকার ৫০-৬০ জন যুবক ঢ্যাবঢেবি ফেরিঘাটে গিয়ে টিকিট কাউন্টার, শৌচাগার ভেঙে তছনছ করে। ঘাটে লাগানো সিসিক্যামেরা ভেঙে গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়। ফেরিঘাটের অফিসের কম্পিউটারও আছড়ে ভেঙে দেওয়া হয়। মারমুখী যুবকেরা ঘাটে ভুটভুটির তেল ছড়িয়ে আগুন লাগানোর চেষ্টা করে। ঘাটকর্মীরা ঠেকান। হামলাকারীরা সেখান থেকে ফিরে গিয়ে জুটমিলের দু’টি গেট সংলগ্ন তৃণমূলের দু’টি দলীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর চালায়। শাসকদলের দলীয় পতাকাতেও আগুন ধরিয়ে দেয়। শেষে শ্রমিক মহল্লা লাগোয়া তৃণমূল নেতা চন্দন বর্মণ এবং পরিমল সিংহরায়ের বাড়িতেও হামলা চালায় তারা। পুলিশ ঢুকলে হামলাকারীরা চম্পট দেয়। এলাকায় তিনটি পুলিশ পিকেট বসানো হয়। ১০ জনকে আটক করা হয়।
প্রায় এক বছর বন্ধ থাকার পরে গত মাসের ২০ তারিখে যখন ওই জুটমিলের দরজা খোলে, শ্রমিকদের অনেকেরই মনে হয়েছিল, ‘ভোটের চমক’। ভোট মিটলে জুটমিল বন্ধ হবে, এ আশঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন তাঁরা। তাই বুধবার সকালে মিলের গেটে কাজ বন্ধের নোটিস দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন শ্রমিকেরা। সে খবর পৌঁছয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি তখন পুরুলিয়ার হুড়া ব্লকের লধুড়কায় নির্বাচনী সভায় ছিলেন। শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটককে পাশে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জুটমিল কর্তৃপক্ষকে কড়া বার্তা দেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক কিছুক্ষণ আগে বলছিল, চন্দননগরের একটা জুটমিল কয়েকদিন আগে খোলা হয়েছিল। তার মালিক দুষ্টুমি করে আজ বন্ধ করেছে। হয় মালিক জুটমিল খুলবেন, না হলে আইনত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমি এ সব সহ্য করব না।’’ মমতার সংযোজন, ‘‘কেউ যদি মনে করে কারও কথায় খুলবে, কারও কথায় বন্ধ করবে, আমি এটা করতে দেব না। যদি কেউ প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা ফাঁকি দেয়, মজদুরদের টাকা ফাঁকি দেয়, তা হলে আইনত ব্যবস্থা নেব। সাত দিন আগে তুমি খুলে বন্ধ করবে কেন? না-খুললে তিন দিন সময় দাও, না হলে একদম গ্রেফতার করবে।’’
পরে রাজ্যের মন্ত্রী তথা চন্দননগরের বিধায়ক ইন্দ্রনীল সেন বলেন, ‘‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আজ ওখানে অশান্তি হয়েছে। ওই মিল খুলতে মুখ্যমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হয়েছিলেন। আমার সব পক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে। আজ, বৃহস্পতিবার ফের গোন্দলপাড়া জুটমিলের দরজা খুলবে।’’ সন্ধ্যায় ফের জুটমিলের গেটে আজ থেকে খোলার নোটিস টাঙানো দেখে শ্রমিকদের অনেকে চমকে যান। মিলের পার্সোনেল ম্যানেজার বলেন, ‘‘কাঁচামালের অভাব এবং শ্রমিকদের অনুপস্থিতির জন্য সমস্যা হচ্ছিল। তাই সাময়িক সাসপেনশনের নোটিস দিতে হয়। রাজ্য সরকারের উদ্যোগে ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, বৃহস্পতিবার থেকে মিল খুলবে।’’
তবু আশ্বস্ত হতে পারছেন না স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে মিলের প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক। তাঁরা মনে করছেন, এখন মুখ্যমন্ত্রী কড়া বার্তা দেওয়ায় মিলটি খোলা হলেও আবার কিছুদিন বাদে বন্ধ হবে। এমন খোলা-বন্ধের ‘খেলা’ দীর্ঘদিন ধরে চলছে বলে তাঁদের অভিযোগ। মিলের রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের শ্রমিক রাজেশ জয়সোয়ারার ক্ষোভ, ‘‘গত মাসে মিলটি খোলার পরেও কর্তৃপক্ষ কোনও নিয়ম মানেননি। মিলে হাজিরা খাতাও ছিল না। ছিলেন না কর্তৃপক্ষের তরফে কেউ। উৎপাদন চালুও হয়নি। শ্রমিকেরা বকেয়া টাকাও পাননি। বিধি অনুযায়ী মেলেনি সরকারি আর্থিক অনুদানও। এ বারও হয়তো মিল খোলার নামে আবার নাটক হবে।’’
চন্দননগরের উপ শ্রম-কমিশনার কিংশুক সরকার জানান, গত মাসে মিলটি খোলার পর থেকে শ্রম দফতরের পক্ষ থেকে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছিল। তিনি বলেন, ‘‘কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিলেন, বিভিন্ন বিভাগে সঠিক সংখ্যায় শ্রমিকেরা কাজে যোগ দিচ্ছেন না। আসলে ১১ মাস মিলটি বন্ধ ছিল। শ্রমিকেরা রুটি-রুজির টানে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছিলেন। শ্রমিকদের পক্ষে কাজে যোগ দেওয়ার কিছু বাস্তব
সমস্যা ছিল।’’
পরিস্থিতির জন্য রাজ্য সরকারকে দুষছে বিরোধী নেতারা। চন্দননগরের সিপিএম নেতা রতন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘জুটমিলটি নিয়ে কোনও স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না। ভোটের আগে খোলা হয়েছিল। এখনও ভোটের দু’টি পর্ব বাকি রয়েছে। তাই মুখ্যমন্ত্রী ব্যবস্থা নিয়েছেন। এক বছর ধরে মিলটি বন্ধ থাকার সময়ে মুখ্যমন্ত্রী কড়া বার্তা দেননি কেন? শ্রমিকদের ক্ষোভ স্বাভাবিক।’’ মিল খোলাকে ‘রাজনৈতিক চমক’ বলে মনে করছেন বিজেপির সংখ্যালঘু সেলের রাজ্য নেতা স্বপন পালও।