তোড়ে: বকপোতা সেতুর কাছে বাঁধ ভেঙে জল ঢ়ুকছে আমতার গ্রামে। ছবি: সুব্রত জানা
শেষরক্ষা হল না।
বালির বস্তা রোধ করতে পারল না আরামবাগের দ্বারকেশ্বরের নদীবাঁধের ভাঙন। বুধবার সকালে ফের ডুবল শহর। একই সঙ্গে প্লাবিত হল মহকুমার বাকি অংশও। দুর্গতদের কেউ আশ্রয় নিলেন ত্রাণ শিবিরে, কেউ বা সরে গেলেন উঁচু জায়গায়।
সেচ দফতর জানিয়েছে, মহকুমার চারটি নদীই (দ্বারকেশ্বর, দামোদর, মুণ্ডেশ্বরী এবং রূপনারায়ণ) চরম বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে। টানা বৃষ্টিতে শনিবারই প্লাবিত হয়েছিল আরামবাগ শহরের অধিকাংশ এলাকা। তার পরে তিন দিন ধরে জল নামতে থাকায় কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলেন মানুষ। কিন্তু তা স্থায়ী হল না। মঙ্গলবার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের জুবিলি পার্কের গায়ে ওই বাঁধ চুইয়ে জল ঢুকছে দেখে সেচ দফতর বালির বস্তা দিয়ে তা সামলানোর চেষ্টা করে। রাতে পাহারাও দেওয়া হয়। কিন্তু বুধবার ভোর ৫টা নাগাদ বাঁধের ২০ ফুটেরও বেশি অংশ ভেঙে যায়। জল ঢুকতে থাকে শহরে। আতঙ্কে ভুগতে থাকেন মানুষ। একতলা দোকান থেকে মালপত্র সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ব্যবসায়ীরা। বহু একতলা বাড়িতেও জল ঢুকে যায়। আরামবাগ জেল থেকে কয়েদিদের বাঁকুড়া জেলে স্থানান্তরিত করানো হয়।
১৯৭৮ সালের বন্যার সময়ে ওই বাঁধ উপচে শহর জলমগ্ন হয়েছে। কিন্তু তা ভাঙেনি। তা হলে এ বার ভাঙল কেন?
সাধারণ মানুষ এ জন্য পুরসভা এবং প্রশাসনের গাফিলতির অভিযোগ তোলেন। সেচ দফতর দায়ী করেছে পুরসভাকে। আরামবাগ মহকুমা সেচ দফতরের সহকারী বাস্তুকার প্রিয়ম পালের অভিযোগ, পুরসভা সেত দফতরের অনুমতি না-নিয়ে গত মার্চ মাস নাগাদ ওই বাঁধ কেটে একটি পানীয় জলের পাইপ বসায়। অনুমতি না নিয়েই নদীর চর ভরাট করে মাঠ বানিয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘একদিকে জলের গতির বাধা, অন্যদিকে ফোকর হয়ে যাওয়ার কারণেই বাঁধ ভেঙেছে।’’
পুরপ্রধান স্বপন নন্দী অভিযোগ মানেননি। তাঁর দাবি, “পাইপ বসানো বা মাঠ করার জন্য কিছু হয়নি। ওই জায়গাটা ভাঙনপ্রবণ। আগে অন্তত চার বার ওই জায়গায় ভাঙন
হতে দেখেছি।”
এ দিন অনেকেই ঘুম ভাঙে বাঁধ ভাঙার খবরে। দলে দলে লোকজন রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। নিমেষে জুবিলি পার্ক সংলগ্ন কয়েকটি স্কুলের একতলা ডুবে যায়। ডুবে যায় মাঠের দক্ষিণের একটি ক্লাব এবং উত্তরে ইদগাহ। সকাল ৯টা নাগাদ আবার শহরের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সতীতলার কাছেও বাঁধ ভাঙে। কোর্ট রোডে কোমরসমান জল দাঁড়িয়ে যায়।
মহকুমা ত্রাণ আধিকারিক সৌমেন দাস জানিয়েছেন, এখনও পর্যন্ত ২৬৬টি বাড়ি সম্পূর্ণ ভাবে এবং ১৩০৭টি কাঁচাবাড়ি আংশিক ভেঙেছে। মোট ৪১টি ত্রাণ শিবিরে ৩৪ হাজার ৭৯১ জনকে রাখা হয়েছে। ৮ হাজার ৭৯১ হেক্টর চাষজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার জলে ডুবে মৃত্যু হয়েছে এক জনের। গত সোমবার গোঘাটের কামারপুকুরের ইন্দিরা গ্রামের খালে তলিয়ে গিয়েছিলেন শ্যামল সেনগুপ্ত নামে এক যুবক। এ দিন সকালে তাঁর দেহ মেলে ঘটনাস্থল থেকে কিছুটা দূরে একটি খালে।
খানাকুল এবং গোঘাটের বেশ কিছু রাস্তা জলের তলায় চলে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। খানাকুল-১ নম্বর ব্লকে দ্বারকেশ্বর নদীবাঁধের নিচু অংশ (হানা) টপকে জল ঢোকায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে খান তিরিশেক গ্রাম। খানাকুল-২ নম্বর ব্লকের ১১টি পঞ্চায়েতের ৬৮টি গ্রামই জলমগ্ন। মহকুমার প্লাবিত এলাকাগুলির সব স্কুলে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ছুটি ঘোষণা করেছে প্রশাসন।
এ দিন প্লাবিত নানা এলাকা পরিদর্শনে এসে কৃষি বিপণনমন্ত্রী তপন দাশগুপ্ত জানান, পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা রয়েছে। তবু, ত্রাণ নিয়ে ক্ষোভ সামনে আসছে। ত্রাণ শিবিরে শিশুখাদ্য দেওয়ারও দাবি উঠেছে। দ্বারকেশ্বর নদীর ধারে বড়ডোঙ্গল গ্রামে জল ঢুকেছে। সেখানকার রমেন দাস নামে এক যুবক বলেন, ‘‘ত্রাণের উপর ভরসা করেই প্রতি বছর এই দিনগুলি কাটাতে হয়।”