চিহ্ন: বোমা ফাটানোর দাগ। নিজস্ব চিত্র
নির্বাচন কমিশনের নিরাপত্তার আশ্বাস, কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহলদারি, পুলিশি ধরপাকড় সত্ত্বেও এ বারের ভোটে হিংসা বন্ধ হয়নি। এড়ানো যাচ্ছে না বোমাবাজিও। আগামী সোমবার হুগলিতে ভোট। সে দিন এখানেও বোমার শব্দ, জখমদের আর্ত চিৎকার শুনতে হবে কিনা, এ প্রশ্ন উঠছে। রবিবার গভীর রাতেই ব্যান্ডেলের লিচুবাগানের মানসপুর এলাকায় বোমাবাজি হয়েছে। যার জেরে আতঙ্কও ছড়িয়েছে এলাকায়।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, রবিবার রাত দেড়টা নাগাদ মানসপুরে একটি বাড়ির সামনে পরপর কয়েকটি বোমা ফাটিয়ে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা। তাতে অবশ্য কেউ হতাহত হননি। এলাকাবাসী থানায় অভিযোগ জানানোয় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন পুলিশ কমিশনারেটের এক কর্তা।
ভোটের মুখে এই ঘটনায় লেগেছে রাজনীতির রং। তৃণমূল পরিচালিত ব্যান্ডেল পঞ্চায়েতের উপপ্রধান প্রদীপ রায়ের অভিযোগ, ‘‘বিজেপি নিজেদের দলীয় কোন্দল ঢাকতে ওই বোমাবাজি করেছে।’’ অভিয়োগ উড়িয়ে দিয়েছেন জেলা বিজেপির ওবিসি মোর্চার সাধারণ সম্পাদক সুরেশ সাউ। তাঁর পাল্টা অভিযোগ, ‘‘পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে বুঝে তৃণমূলই ওই হামলা চালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এলাকা দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে।’’
ভোট-মরসুমে বোমার ব্যবহার নিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন সংগঠনের তরফে আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। সে ক্ষেত্রে বেআইনি বাজি কারখানা বন্ধ করার দাবিও উঠেছিল। কারণ, ওই সব কারখানাকে বোমা তৈরির কাজে দুষ্কৃতীরা ব্যবহার করে বলে অভিযোগ। ফলে, হুগলিতে ভোটের দিন বোমার ব্যবহার নিয়ে আশঙ্কা থাকছেই। চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেট এলাকার সাতটি এবং জেলা (গ্রামীণ) পুলিশের ১৬টি থানা এলাকাতেই কমবেশি বেআইনি বাজি কারখানা রয়েছে। সেই সব কারখানা বন্ধ করা হয়নি বলে অভিযোগ।
চন্দননগরের আইন সহায়তা কেন্দ্রের কর্ণধার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শুধু দিল্লি এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশন নয়, আমরা রাজ্য পুলিশের সব কর্তা, জেলা পুলিশ সুপারদের কাছেও লিখিত ভাবে আবেদন করেছিলাম, বেআইনি বাজি কারখানাগুলিকে ‘সিল’ করে দিতে। তা হলেই ভোটে রক্তপাত আর মৃত্যু ঠেকানো যাবে। কিন্তু তা হল কই?’’
ভোটের দীর্ঘদিন আগে থেকেই আধাসেনা রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। এখন সাধারণ মানুষই প্রশ্ন তুলছেন, আধাসেনাকে কি যথাযথ ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে? তা হলে কেন বোমাবাজি, রক্তপাত এড়ানো যাচ্ছে না? হুগলি জেলা (গ্রামীণ) ও চন্দননগর কমিশনারেটের পদস্থ পুলিশকর্তারা অবশ্য দাবি করেছেন, পুলিশ হাত গুটিয়ে বলে নেই। লাইসেন্সহীন (শংসাপত্র ) বাজি কারখানাগুলিতে নিয়মিত পুলিশের হানাদারি চলছে। ইতিমধ্যেই চণ্ডীতলা থানার পুলিশ বিভিন্ন এলাকায় হানা দিয়ে কয়েক টিন ভর্তি বাজির মশলা উদ্ধার করেছে। ডানকুনির কালীপুর, ২০ এবং ২১ নম্বর ওয়ার্ডের মালপাড়া, হাঁসপুকুর, ডানকুনি লাগোয়া জগদীশপুরে বাজি তৈরি হয়। চণ্ডীতলার শিয়াখালা, কলাছড়া, বেগমপুর, হরিপাল, পোলবার একাংশে, জাঙ্গিপাড়া থানার ফুরফুরায় বেআইনি বাজি তৈরির বহু কারখানা রয়েছে। সিঙ্গুরের বাসুবাটি এলাকাতেও রয়েছে। কলকাতার বাজারে বাজির অন্যতম প্রধান জোগানদার এই জেলা।
কিন্তু এক পুলিশকর্তা মানছেন, বহু সময় দুষ্কৃতীরা চড়া দামে বাজি-কারবারিদের দিয়েই বোমা তৈরি করায়। গত বছর পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে আরামবাগ মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় বোমাবাজির ঘটনায় জখম হন বেশ কয়েক জন। কয়েক বছর আগে ভয়াবহ বাজি বিস্ফোরণে বেগমপুর ও ধনেখালিতে অন্তত দশ জনের মৃত্যু হয়েছিল। পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তারা জানান, জেলা প্রশাসনের তরফে কয়েক বছর আগে বেআইনি বাজি কারখানাগুলিকে লাগাম পরাতে এবং মৃত্যু ঠেকাতে রাজ্য সরকারের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, ‘ক্লাস্টার’ তৈরি করে শব্দহীন বাজি তৈরিতে আইনি মোড়ক দেওয়া হোক। কিন্তু সেই প্রস্তাবে এখনও বিশেষ সাড়া মেলেনি।