নোটবন্দি-জিএসটির ধাক্কায় কুপোকাত ধনেখালির তাঁত

টেকসই, পাকা রঙের জন্য ধনেখা‌লি তাঁতের শাড়ির কদর বরাবরের। এলাকায় কয়েক হাজার তাঁতি রয়েছেন। কিন্তু এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেরই বক্তব্য, বেশ কয়েক বছর ধরেই তাঁত শিল্পে মন্দা চলছে।

Advertisement

প্রকাশ পাল

ধনেখালি শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৭ ০৩:৩৭
Share:

সুনসান: দোকানে ভিড় নেই ক্রেতার। নিজস্ব চিত্র

পড়ন্ত বিকেলে খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির ঘরে এক মনে তাঁত বুনছিলেন প্রৌঢ়। এক বছর আগের নোটবন্দির কথা শুনেই মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল বিশ্বনাথ লাহার। ধনেখালির মদনমোহনতলার ওই তাঁতশিল্পীর আক্ষেপ, প্রথমে নোটবন্দি এবং তার পরে জিএসটির ‘কোপে’ কোণঠাসা অবস্থা ধনেখালির তাঁতিদের!

Advertisement

টেকসই, পাকা রঙের জন্য ধনেখা‌লি তাঁতের শাড়ির কদর বরাবরের। এলাকায় কয়েক হাজার তাঁতি রয়েছেন। কিন্তু এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেরই বক্তব্য, বেশ কয়েক বছর ধরেই তাঁত শিল্পে মন্দা চলছে। তার উপর নোটবন্দি-জিএসটির ধাক্কায় রীতিমতো কুপোকাৎ এলাকার তাঁতশিল্প।

তাঁতিরাই জানালেন, এক সময় মহাজনের মাধ্যমে কাজ করতে হতো। পরে সমবায় ব্যবস্থা আসে। বর্তমানে ধনেখালি ব্লকে একাধিক তাঁত সমবায় সমিতি রয়েছে। সমবায় তাঁতিকে সুতো দেয়। শাড়ি তৈরি করে সমবায়ে দিয়ে যান তাঁতি। বিনিময়ে মজুরি পান। তাঁতিদের বক্তব্য, এক বছর আগে কেন্দ্রীয় সরকার ১০০০ এবং ৫০০ টাকার নোট তুলে নেওয়ার পরে ব্যাঙ্কের লেনদেন‌ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সমবায় শিল্পীরা সমবায় থেকে মজুরিটুকুও পাচ্ছিলেন না। বিশ্বনাথবাবু বলেন, ‘‘তখন সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে ৫-৬ মাস লেগেছিল। সেই ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই জিএসটি-র কোপ।’’

Advertisement

ধনিয়াখালি ইউনিয়ন তাঁতশিল্প সমবায় সমিতিতে প্রায় আড়াইশো তাঁতি রয়েছেন। সমবায়-কর্তাদের বক্তব্য, সরকারি সংস্থার পাশাপাশি খোলা বাজার থেকে তাঁদের সুতো, রং কিনতে হয়। খোলা বাজারের অনেক ব্যাপারি জিএসটি যুক্ত পাকা বিল দিতে চান না। এতে তাঁদের হিসেব রাখতে সমস্যা হয়। সারা বছর সমিতি ক্রেতাদের ৫% ছাড় দেয়। এখন একই পরিমাণ টাকা জিএসটি হিসেবে নিতে হচ্ছে। ফলে খদ্দের আসছে না। বিক্রি তলানিতে ঠেকেছে।

সমবায়ের সম্পাদক দীনবন্ধু লাহা বলেন, ‘‘অন্য বছর পুজোর সময় খদ্দেরদের শাড়ি দিয়ে সামাল দিতে পারি না। আর এ বছর প্রচুর শাড়ি জমে গিয়েছে। কিন্তু তা বলে শাড়ি তৈরি কমানোর উপায় নেই। তা হলে তাঁতিরা আরও সমস্যায় পড়বেন। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে কি হবে, কে জানে!’’ সমবায়ের কর্মী মানস পাল, প্রদীপ দত্তদের বক্তব্য, ‘‘মাছি তাড়াতে হচ্ছে। সোমবার সারাদিনে মাত্র ২টো শাড়ি বিক্রি হয়েছে।’’

সমিতি সূত্রের খবর, গত অক্টোবর মাসে ২৬০টি শাড়ি বিক্রি হয়েছে। অন্যান্য বার এই সময় প্রায় সাড়ে চারশো শাড়ি বিক্রি হয়। তন্তুজের মতো সরকারি সংস্থা শাড়ি কিনবে, এই আশায় রয়েছেন সমিতির কর্তারা। সমিতির কোষাধ্যক্ষ মোহনলাল দত্তের বক্তব্য, ‘‘জিএসটির হিসেব সামলানোও সমস্যার। অনলাইনের কাজকর্মে সড়গড় নই। কলকাতায় গিয়ে কাজ করিয়ে আনতে হচ্ছে।’’

ধনেখালির মির্জানগরের বাসিন্দা, বছর চৌষট্টির তাঁতশিল্পী তপন নন্দী বলছিলেন, ‘‘১৯৭৪ থেকে তাঁত বুনি। এখন পরিস্থিতি খুব খারাপ। শাড়ি বিক্রি না হওয়ায় সমিতি বলছে, নতুন ডিজাইন করতে। কিন্তু অন্য ঘরানার শাড়ি বুনলে এখানকার বিশেষত্বই তো হারিয়ে যাবে।’’ তিনিই জানালেন, ক্রেতা টানতে এখন তাঁতের শাড়িতে প্রিন্টিংও করা হচ্ছে।

বিশ্বনাথবাবুরা বলছেন, ‘‘নোটবন্দি-জিএসটি করে লাভ হয়নি। নতুন প্রজন্ম কিন্তু এই কাজে আসছে না। ধনেখালির তাঁতশিল্প এখন ধ্বংসের দিন গুনছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন