চটকল শ্রমিকের মৃত্যুতে নানা প্রশ্ন

কেউ দুষছেন চটকল কর্তৃপক্ষকে, কেউ ‘নিয়মের গেরো’কে, কেউ আবার কপালকে!

Advertisement

প্রকাশ পাল 

চন্দননগর শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৯ ০৫:১৭
Share:

মৃত: নন্দকিশোর দাস।

কেউ দুষছেন চটকল কর্তৃপক্ষকে, কেউ ‘নিয়মের গেরো’কে, কেউ আবার কপালকে!

Advertisement

কয়েক মাস রোগ ভোগের পরে রবিবার রাতে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে মৃত্যু হল চন্দননগরের বন্ধ গোন্দলপাড়া চটকলের শ্রমিক নন্দকিশোর দাসের (৪২)। আর এই মৃত্যু তুলে দিল একগুচ্ছ প্রশ্ন।

এর আগে কয়েকটি ইএসআই হাসপাতালে উপযুক্ত চিকিৎসা না-পাওয়া এবং ইএসআই সংক্রান্ত নিয়মের জন্য বাবা মারা গেলেন বলে অভিযোগ তুলেছেন নন্দকিশোরের বড় মেয়ে পুনম। তাঁর দাবি, ‘‘বাবার ইএসআই সংক্রান্ত টাকাই জমা দেননি চটকল কর্তৃপক্ষ। তাই ঠিক চিকিৎসাও হয়নি। এতে বাবার কি দোষ?’’ চন্দননগর আইনি সহায়তা কেন্দ্রের সম্পাদক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের ক্ষোভ, ‘‘তচকল কর্তৃপক্ষের অপদার্থতা, রাজ্য সরকারের উদাসীনতা এবং কেন্দ্রের ইএসআই সংক্রান্ত অমানবিক সিদ্ধান্তের ফলেই ওই শ্রমিকের মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়েছে।’’

Advertisement

গত বছর ২৬ মে থেকে গোন্দলপাড়া চটকল বন্ধ। এর পিছনে চটকলের মালিকপক্ষ আর্থিক অসঙ্গতিকে কারণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন। মৃতের পরিবারের লোকেরা জানান, চটকল বন্ধের পরে এক মাস রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করেন নন্দকিশোর। সেপ্টেম্বরে অসুস্থ হন। তখন থেকে ভদ্রেশ্বর, শিয়ালদহ, মানিকতলা ইএসআই, কখনও ইএসআই হাসপাতালের সঙ্গে সংযোগ থাকা বেসরকারি হাসপাতালেও তাঁকে নিয়ে ছুটে বেড়াতে হয়েছে।

সোমবার দুপুরে ভদ্রেশ্বরের শ্মশানে বাবার দেহ সৎকার করতে এসে পুনম বলেন, ‘‘ডাক্তারদের সন্দেহ ছিল, ক্যান্সার। অনেক টালবাহানার পরে পরীক্ষা হলেও রোগ নির্ণয় নাকি করাই যায়নি! আরও পরীক্ষার দরকার থাকলেও হয়নি।’’ কিন্তু কেন? হিন্দি অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রীটির অভিযোগ, গত ৪ জানুয়ারি বাবাকে ভদ্রেশ্বর ইএসআই থেকে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানোর তোড়জোড়ের সময়েই জানা যায়, ইএসআই সংক্রান্ত টাকা (স্থানীয় কথায় চাঁদা) জমা না-পড়ায় যে ধরনের চিকিৎসা প্রয়োজন, তা মিলবে না। ৬ জানুয়ারি মানিকতলা ইএসআই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে তিন বার পেট থেকে জ‌ল বের করা ছাড়া আর কিছু হয়নি। গত শনিবার এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। অভিযোগ উড়িয়ে ভদ্রেশ্বরের ইএসআই হাসপাতালের সুপার অভ্রজিৎ মুখোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘নিয়মের বাইরে আমরা তো যেতে পারি না। তবে যে টুকু করার, সেই চেষ্টা হয়েছে।’’

গোন্দলপাড়ার মালাপাড়া কালীতলায় মেরেকেটে একটা ছোট ভাড়াঘরেই নন্দকিশোরের সংসার। প্রায় ঘরজোড়া খাট। দু’পাশে রান্নার ওভেন, টিভি, সেলাই মেশিন, ঠাকুরের সিংহাসন। নন্দকিশোরের স্ত্রী রিতাদেবীর প্রশ্ন, ‘‘পাঁচ মেয়েকে নিয়ে এখন চলব কী করে?’’ পুনম বলেন, ‘‘এসএসকেএম-এর চিকিৎসকেরা জানান, বাবার যা অবস্থা, তাতে কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপির ধকল নিতে পারবেন না। তাই ওষুধ দিয়ে একটু চাঙ্গা করার চেষ্টা করছিলেন তাঁরা। এখন আমাদের কে দেখবে? আমার, চার বোনের পড়াশোনারই কী হবে?’’ পুনমের মেজো বোন, একাদশ শ্রেণির ছাত্রী পূজা বলে, ‘‘কয়েক মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি। অনেক টাকা ধার হয়ে গিয়েছে।’’ স্থানীয় যুবক দেবেশ সাউয়ের প্রশ্ন, ‘‘শ্রমিকদের দূরাবস্থা এই মৃত্যু ফের চোখে আঙু‌ল দিয়ে দেখিয়ে দি‌ল। এতেও কি চটকল কর্তৃপক্ষের হুঁশ ফিরবে না?’’

চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগে ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে মামলা করতে চায় মৃতের পরিবার। হুগলি জেলা আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষের (ডালসা) প্যারালিগাল‌ ভলান্টিয়ার জোয়ালাপ্রসাদ মাহাতো জানান, পরিবারটিকে প্রয়োজনে আইনি সহায়তা দেওয়া হবে। এ দিন ওই শ্রমিকের বাড়িতে যান চন্দননগর আইনি সহায়তা কেন্দ্রের সম্পাদক বিশ্বজিৎবাবু। পরিবারটিকে সাহায্যোর আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘নন্দকিশোরের মেয়েরা যাতে পড়া চালিয়ে যেতে পারে, সেই চেষ্টা করব।’’ শ্রমিকের মৃত্যু নিয়ে চটকল কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া মেলেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন