পাচার-চক্র ভাঙছেন মনিকা

পাকেচক্রে বারো বছরে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সংসারের অভিজ্ঞতা সুখের নয়। বাঁচার তাগিতে ছোট্ট দুই মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে এসেছিলেন শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে। সেখান থেকে শুরু এক নতুন লড়াইয়ের। পাচার হয়ে যাওয়া কিশোরী-তরুণী উদ্ধার করাই এখন ব্রত বসিরহাটের মনিকা সরকারের। এই কাজে এখন প্রশাসনেরও ভরসা তিনি।

Advertisement

প্রকাশ পাল

শ্রীরামপুর শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৫ ০০:৪৭
Share:

— নিজস্ব চিত্র।

পাকেচক্রে বারো বছরে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সংসারের অভিজ্ঞতা সুখের নয়। বাঁচার তাগিতে ছোট্ট দুই মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে এসেছিলেন শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে। সেখান থেকে শুরু এক নতুন লড়াইয়ের। পাচার হয়ে যাওয়া কিশোরী-তরুণী উদ্ধার করাই এখন ব্রত বসিরহাটের মনিকা সরকারের। এই কাজে এখন প্রশাসনেরও ভরসা তিনি।

Advertisement

কয়েক বছরে উত্তর ২৪ পরগনা জেলা জুড়ে পাচার হওয়া কয়েকশো মেয়েকে উদ্ধার করা আনায় হাত রয়েছে মনিকার। ‘সাম্য শ্রমজীবী সমিতি’ নামে সংগঠন গড়ে মেয়েদের বিরুদ্ধে অন্যায় রুখতে দিনরাত এক করে ফেলছেন তিনি। এই ‘যুদ্ধে’ পাশে পেয়েছেন অনেককে। জেলাশাসক মনমীত নন্দা বলেন, ‘‘মনিকার কাজে প্রশাসন সর্বতো ভাবে সাহায্য করবে। উদ্ধার হয়ে যাওয়া মেয়েদের সমাজের মূলস্রোতে ফেরাতে সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।’’

মনিকা বাদুড়িয়ার শায়েস্তানগর গ্রামে থাকেন। সংগঠনের দফতর বাদুড়িয়ারই কাটিয়াহাটে। সংগঠনের কর্মীরা জানান, পুলিশের সাহায্য নিয়ে পাচার হয়ে-যাওয়া ৭০০ মেয়েকে উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়ার পরে অনেককে সংগঠনের কর্মীদের বাড়িতে রাখা হয়। বেশির ভাগই দেগঙ্গা, সন্দেশখালি এবং হাড়োয়া ব্লকে। গাইঘাটারও আছে। ইউনিটের পুরো সময়ের কর্মী ১০ জন। প্রায় সাড়ে তিনশো স্বেচ্ছাসেবকও আছেন। পাচার হওয়া মেয়েদের অনেকে ফিরে এসে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে। মুম্বইয়ের যৌনপল্লি থেকে ফেরার পরে এক জনের ভাল ঘরে বিয়ে হয়েছে। এখন অন্তঃসত্ত্বা। তিনি এই সংগঠনের কর্মী। ‘‘ওর ফোন পেয়ে রেসকিউ করে এনেছিলাম,’’— মনিকা বলেন। পাচারের পাশাপাশি বাল্যবিবাহেরও খবর জুটিয়ে আনেন স্বেচ্ছ্বাসেবকরা। মনিকা জানান, বছর দশেক আগে পাচার রুখতে প্রচারের কাজ মেলে জেলা প্রশাসনের তরফে। বছর চারেক পরে সালে চাইল্ড লাইন এ নিয়ে যৌথ ভাবে কাজ করার প্রস্তাব দেয়। তত দিনে বাদু়ড়িয়া, বসিরহাট, স্বরূপনগর ব্লক জুড়ে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রথম দিকে গাইঘাটাও ছিল। ‘‘২০০৬ সালে পড়তে যাওয়ার সময় ক্লাস সেভেনের একটা মেয়েকে বাসে করে তুলে নিয়ে যান এক মহিলা। রাতে গোলাবাড়ির কাছ থেকে মেয়েটাকে উদ্ধার করি। তার পরে আরও একটা...।’’ ডায়েরির পাতা উল্টনোর মতো করে বলে চলেন মনিকা।

Advertisement

সঙ্গীদের অভিজ্ঞতা বলছে, এক সময় পুলিশ অভিযোগ নিতে চাইত না। বলত, বাড়ির লোকই মেয়েকে কাজে পাঠিয়ে পাচারের গল্প ফাঁদছে। পঞ্চায়েতে গেলে নানা কটূক্তি শুনতে হয়েছে। কেউ বলেছে ‘আপনারাই পাচারকারী!’ প্রতিকুল পরিস্থিতিতে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন মনিকা। একটা সময় পুলিশই পাচার রোধে মিলিত ভাবে কাজ করার কথা বলে। পায়ের তলায় জোর পেয়ে জোরকদমে কাজ শুরু হয়। থানার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বি়ডিও, সিডিপিওদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এখন এলাকায় তাঁদের সবাই চেনে, সম্মান করে, তৃপ্তির হাসি হাসেন মনিকা। পরিস্থিতি ঠিক কতটা বদলেছে? শক্ত হয়ে ওঠে চোয়াল। বলে চলেন, ‘‘হুমকি এখনও আসে। মুম্বই থেকে একটা মেয়েকে উদ্ধার করে আনার পরে কী হুমকি!’’ সে বারেও অভিযোগ নিচ্ছিল না থানা। এফআইআর করতে সিআই, এসডিপিও, এসপি-কে চিঠি লিখতে হয়। শেষে এক অভিযুক্তকে পুলিশ ধরে। তার পরেই মামলা তুলতে প্রচণ্ড চাপ শুরু হয়। আর একবার বসিরহাট স্টেশন থেকে একটা মেয়েকে উদ্ধারের পরে মনিকার বাড়িতে হামলাও হয়।

এই লড়াইয়ের শুরু নিজের জীবন থেকে। মনিকার কথায়, ‘‘একটা ছেলে উত্ত্যক্ত করত। পাছে তুলে নিয়ে যায়, সেই ভয়ে মা বিয়েতে রাজি হন।’’ বিয়ের পরে অত্যাচার শুরু হয়। পর পর দুই মেয়ে হওয়ায় অত্যাচার বাড়ে। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে অষ্টম শ্রেণির বেশি এগোতে পারেননি। কাজের সূত্রে স্বামী বেশির ভাগ সময় বাইরেই থাকতেন। একটা সময় মেয়েদের বাঁচানোর তাগিদে শ্বশুরবাড়ি ছাড়েন। গরু-ছাগল পুষে আর মাঠে মজুর খেটে শুরু হয় নতুন লড়াই। মেয়েদের নিয়ে স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করেন। শেষে ‘সাম্য শ্রমজীবী সমিতি’ গড়েন।

সংগঠনের কাজ করতে করতে মুক্ত বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন মনিকা। বিএ পড়ছেন। বড় মেয়ে সুমনাও বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ছোট মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ছে। মেয়েরাও মাকে কাজে সাহায্য করে। সঙ্গী আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘এখন সবাই জেনে গিয়েছে হুমকি দিয়ে, আক্রমণ করে দমানো যাবে না। তবে, এখনও অনেক দূর যেতে হবে।’’

রবিবার শ্রমজীবী হাসপাতালের তরফে মনিকাকে ‘অনন্য মানবিক কাজ’-এর জন্য পুরস্কৃত করা হবে। ওই হাসপাতালের তরফে গৌতম সরকার বলেছেন, ‘‘খুবই কঠিন আর ঝুকিপূর্ণ কাজ হাসিমুখে করে চলেছেন মনিকাদেবী। পাচার হওয়া মেয়েদের সামাজিক পুনর্বাসনের আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। নিজে পড়াশোনা করে দু’টো মেয়েকেও মানুষ করেছেন। তাঁর এই চেষ্টাকে কুর্নিশ করছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন