‘কোমা’য় গিয়েছে ৩, উজ্জ্বল স্মৃতিতে    

ঐতিহ্যের বাস আবার আসুক ফিরে, সরব নাগরিক সমাজ

‘শ্রীরামপুর মাই লাভ’ এবং ‘কলকাতা বাস-ও-পিডিয়া’ নামে দু’টি সংগঠনের উদ্যোগে রবিবার দুপুরে ওই কর্মসূচি নেওয়া হয়। শ্রীরামপুর স্টেশন সংলগ্ন পুরনো বাসস্ট্যান্ড চত্বরে তাঁরা মিছিল করেন। স্লোগান ওঠে— ‘আসছে দিন, বাঁচান ৩’।

Advertisement

প্রকাশ পাল

শ্রীরামপুর শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share:

মলিন: ধুলো জমছে বাসে। শ্রীরামপুর বাস টার্মিনাসে। ছবি: দীপঙ্কর দে

স্টেশন চত্বরের টোটোর ভিড় পেরিয়ে একফালি ফাঁকা জমির সামনে স্লোগান তুলছিলেন গুটিকয়েক যুবক-যুবতী। হাতে প্ল্যাকার্ড। তাতে শ্রীরামপুর-বাগবাজার ৩ নম্বর রুটের বাসের ছবি।

Advertisement

যেখানে ওই স্লোগান উঠছিল, বছর কয়েক আগেও সেই জমি ভরে থাকত তিন নম্বর বাসে। কিন্তু ওই বাসরুট এখন ‘কোমায়’। গত কয়েক বছরে ৬৯টি থেকে কমতে কমতে এখন একটিতে ঠেকেছে। তবে, সেটি দাঁড়ায় নতুন টার্মিনাসে। সারা দিনে সাকুল্যে দু’বার যাতায়াত করে সেটি। ঐতিহ্যের এই বাসরুট পুনরুজ্জীবনের দাবিতেই পথে নেমেছেন ওই যুবক-যুবতীরা। সঙ্গে বাসমালিক, কর্মীরাও রয়েছেন।

‘শ্রীরামপুর মাই লাভ’ এবং ‘কলকাতা বাস-ও-পিডিয়া’ নামে দু’টি সংগঠনের উদ্যোগে রবিবার দুপুরে ওই কর্মসূচি নেওয়া হয়। শ্রীরামপুর স্টেশন সংলগ্ন পুরনো বাসস্ট্যান্ড চত্বরে তাঁরা মিছিল করেন। স্লোগান ওঠে— ‘আসছে দিন, বাঁচান ৩’। সই সংগ্রহ করা হয়। আন্দোলনকারীদের তরফে অনিকেত বন্দ্যোপাধ্যায়, অতনু মণ্ডলরা জানান, গণস্বাক্ষর সংবলিত দরখাস্ত প্রশাসনের কাছে জমা দেওয়া হবে। অতনু বলেন, ‘‘চোখের সামনে এত ভাল বাসরুট শেষ হয়ে গেল। খুব কম খরচে যাতায়াত করা যেত। ছাত্রছাত্রীদের টিকিটে ছাড় দেওয়া হত। এখন একই গন্তব্যে যেতে দ্বিগুণ, তিন গুণ টাকা এবং সময় খরচ হয়।’’

Advertisement

৩ নম্বর বাসরুট চালু হয় ১৯২৮ সালে। প্রথমে তা ছিল শ্রীরামপুর থেকে বালি পর্যন্ত। তার পরে ডানলপ। কিছু বছরের মধ্যেই বাগবাজার। পরে শ্রীরামপুর-সল্টলেক রুটেও ৩ চলতে থাকে। হাওড়া ও হুগলির বহু মানুষের উত্তর কলকাতার বিস্তীর্ণ এলাকায় যাওয়ার প্রধান মাধ্যম ছিল এই বাস। বাসপ্রতি চালক, কন্ডাক্টর, হেল্পার মিলিয়ে চার জন কর্মী ছিলেন। বদলি শ্রমিক হিসেবেও অনেকে কাজ করতেন। বছর পনেরো আগে থেকে নাভিশ্বাস উঠতে থাকে এই বাসরুটের।

চালু রুটের শেষ পরিণতির জন্য টোটোর দৌরাত্ম্যকেই দায়ী করেছেন বাসমালিক, চালক, কন্ডাক্টররা। আইএনটিটিইউসি প্রভাবিত ৩ নম্বর বাস শ্রমিক-কর্মচারী সংগঠনের সভাপতি, তৃণমূল নেতা অন্বয় চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শুধু বাস চালালেই হবে না। জিটি রোডে টোটো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বিষয়টি পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীকে জানানো হয়েছে। নিত্যযাত্রীরাও চিঠি দিয়েছেন।’’ এই রুটের পুনরুজ্জীবনের দাবিতে কয়েক বছর ধরে আন্দোলন করছে নাগরিক সংগঠন ‘হুগলি জেলা সিটিজেন্স ফোরাম’। সংগঠনের রাজ্য কমিটির সভাপতি, প্রবীণ আইনজীবী শৈলেন পর্বতের ক্ষোভ, ‘‘গঙ্গার উল্টো দিকে ব্যারাকপুর থেকে কলকাতার সঙ্গে বাস যোগাযোগ কত ভাল। এখানে তা থাকবে না কেন?’’

জেলার আঞ্চলিক পরিবহণ অধিকর্তা সোমনাথ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আমাদের দিক থেকে বাসের পারমিট দিতে কোনও সমস্যা নেই। আমি ছুটিতে আছি। কাজে যোগ দিয়েই ওই রুটের লোকজনকে ডেকে এ ব্যাপারে কথা বলব।’’

ওই বাসরুটকে ঘিরে কত মানুষের কত স্মৃতি! স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে স্বপন দাস নামে এক প্রবীণ ঠান্ডা পানীয়ের দোকান চালান। তাঁর কথায়, ‘‘আমি ১৯৬৮ সালে এই লাইনে ঢুকি হেল্পার হিসেবে। তখন ৮ পয়সা ভাড়া। পরে কন্ডাক্টর হই। বাসও চালিয়েছি। এক সময় একটা বাসও কিনি। পরে বেচে দিয়েছি।’’ শ্রীরামপুরের চিকিৎসক-সাহিত্যিক অসিত দত্তের বয়স সাতাশি বছর। তিনি বলেন, ‘‘আমি ষাটের দশকে কলকাতার কাশীপুর থেকে শ্রীরামপুরে এবং পরবর্তীকালে শ্রীরামপুর থেকে কাশীপুরে যাতায়াত করেছি তিন নম্বর বাসে। এক বাসেই যাওয়া যেত। ভাড়াও ছিল কম। শ্রীরামপুর থেকে বাগবাজারে নেমে কিছুটা হেঁটে গিরিশ মঞ্চে কত নাটক দেখেছি!’’

বালির শান্তারাম রোডের বাসিন্দা, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী কমল মুখোপাধ্যায় আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘’৭৮ সালে বিটি রোড গভর্নমেন্ট স্পনসর্ড স্কুলে পড়তাম। ওই বছর ভয়াবহ বন্যাতেও এই রুটের বাস পরিষেবা দিয়েছিল। তখন ১৫ পয়সা ভাড়া ছিল।’’

শ্রীরামপুর বাস টার্মিনাসে ৩ নম্বরের একমাত্র বাসটির দেখা পাওয়া গেল। এ দিন সেটি চলেনি। সাধারণত শ্রীরামপুর থেকে সকাল ৯টায় ছাড়ে। বাগবাজার পৌঁছে সেখান থেকে ফের শ্রীরামপুরে ঢোকে বেলা ১২টা নাগাদ। তারপরে আবার বিকেল ৪টেয় ছাড়ে। বাগবাজার থেকে ছেড়ে শ্রীরামপুরে ঢোকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা নাগাদ। কর্মীরা জানালেন, এখন বাসের ন্যূনতম ভাড়া ৭ টাকা। শ্রীরামপুর থেকে বাগবাজারের ভাড়া ২২ টাকা। সড়কপথে এই গন্তব্যে অন্য উপায়ে যেতে হলে একাধিকবার গাড়ি বদল করতে হবে। খরচ অন্তত ৪০ টাকা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন