কাঠামো: এই জাহাজের উপরে তৈরি হচ্ছে লোহার মণ্ডপ। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার
ডাঙায় নয়, মাঝগঙ্গায়। হাঁটাপথে নয়, জাহাজে। একশো, দু’শো, পাঁচশো নয়, ২১০০ বছর। কলকাতা ও হাওড়া শহরজুড়ে হোর্ডিং, ফেস্টুনে চোখে পড়ছে এমনই ‘ক্যাচলাইন’। এ বার মাঝগঙ্গায় ভাসমান জাহাজের উপরে অভিনব দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। প্রায় ২১০০ বছর আগে কুষাণ যুগে গড়া দুর্গা প্রতিমার আদলে জাহাজে বসবে দেবীর মূর্তি। ইলোরার গুহাচিত্রের অনুকরণে আঁকা ছবিতে সাজবে জাহাজের উপরের মণ্ডপ। চারপাশে থাকবে চন্দননগরের আলো।
হাওড়া স্টেশনের কাছে রামকৃষ্ণপুর ঘাট থেকে একশো ফুট দূরে মাঝগঙ্গায় থাকবে বিশালাকার সেই জাহাজ। হাওড়ার গ্র্যান্ড ফোরশোর রোডে গঙ্গার পার থেকেই দশনার্থীরা পনেরো ফুট উচ্চতার প্রতিমা দর্শন করতে পারবেন। আয়োজক রামকৃষ্ণ স্বামীজি স্মৃতিসঙ্ঘ। সঙ্ঘের সভাপতি সত্যব্রত সামন্তের কথায়, ‘‘ভারতীয় সংস্কৃতির মূল কথাটি হল বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। থিমের যুগে আমরা ইতিহাসে ফিরে যেতে চেয়েছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল, সব থেকে পুরনো প্রতিমার আদল দর্শনার্থীদের সামনে তুলে ধরা।’’ ইতিহাসের সন্ধান পেতে অবশ্য কম পরিশ্রম করতে হয়নি উদ্যোক্তাদের। মাঝগঙ্গায় দুর্গোৎসবের আয়োজনের মূল পৃষ্ঠপোষক মন্ত্রী অরূপ রায়। গত এগারো মাস ধরে রাতকে দিন করে যাঁরা এ বারের পুজোয় চমক দিতে চলেছেন, তাঁরা হলেন হাওড়া পুরসভার ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নারায়ণ মজুমদার ও রাজ্য সমবায় সংগঠনের অধিকর্তা সত্যব্রত সামন্ত। সত্যব্রতবাবুর কথায়, ‘‘এখন চারপাশে থিমের হিড়িক। ইলোরার ভাস্কর্যে মায়ের ছবি আমাদের সকলকে কাছে টানে। গত বছরের পুজোর পর থেকেই মা দুর্গার ইতিহাসের সন্ধানে কলকাতা বইমেলা, জাতীয় গ্রন্থাগার, কলকাতার ভারতীয় জাদুঘর ছাড়াও রাজস্থানের জয়পুর জাদুঘরের সাহায্য নিয়েছি।’’ হাওড়ার পুজো উদ্যোক্তাদের সাধুবাদ জানিয়ে ভারতীয় জাদুঘরের ডেপুটি কিউরেটর নীতা সেনগুপ্ত বলেন, ‘‘প্রায় ২১০০ বছর আগে কুষাণ যুগে প্রথম মা দুর্গার প্রতিমা দেখা গিয়েছে। হাওড়ার পুজো উদ্যোক্তারা দুর্গার ইতিহাসের সুলুকসন্ধানে আমাদের কাছে বারবার এসেছেন। ওঁদের এই উদ্যোগ ইতিহাসপ্রেমীদের সাহায্য করবে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।’’
দু’পাশে রবীন্দ্র সেতু ও দ্বিতীয় হুগলি সেতু। ঠিক মাঝখানে হাওড়ার রামকৃষ্ণপুর ঘাটের সামনেই ভাসমান জাহাজের উপরে থাকবে ১৫ ফুট উচ্চতার প্রতিমা। উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, জাহাজের চারপাশ থেকে চন্দননগরের শিল্পীদের আলোর মায়াজাল রবীন্দ্র সেতু, দ্বিতীয় হুগলি সেতু থেকে শুরু করে কলকাতার দিকে মিলেনিয়াম পার্ক পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে। সংগঠনের সভাপতির কথায়, ‘‘থ্রি ডি আলোকসজ্জার জন্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তা নেওয়া হয়েছে। অন্ধকারে হাওড়া ব্রিজ থেকে বিদ্যাসাগর সেতু পর্যন্ত গঙ্গায় আলোর মায়াজাল তৈরি করা হবে।’’
হাওড়ার ঘুসুড়ির জাহাজ কারখানায় গিয়ে দেখা গেল, জাহাজের উপরে লোহার মণ্ডপ তৈরির কাজ প্রায় শেষ। জাহাজের চালক সনাতন ঘোষের কথায়, ‘‘মাঝগঙ্গায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা মাথায় রেখে চার ইঞ্চি ব্যাসের চার মিলিমিটার পুরু পাইপ ঢালাই করে বসানো হয়েছে।’’ ফাইবারের প্রতিমা তৈরির কাজ করছেন শিল্পী সুধীর মাইতি। সব কিছু ঠিক থাকলে, তৃতীয়ার দিন মাঝগঙ্গায় গিয়ে ভাসমান জাহাজে চেপে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গঙ্গাবক্ষে পুজোর উদ্বোধন করবেন।
হাওড়া পুলিশ সূত্রের খবর, মাঝগঙ্গায় প্রতিমা দর্শন করাতে গ্র্যান্ড ফোরশোর রোড বন্ধ থাকবে। সে ক্ষেত্রে পুজোর ক’দিন হাওড়া শহরে যানজটের আশঙ্কা। হাওড়া পুলিশের এক আধিকারিকের আশঙ্কা, ‘‘মাঝগঙ্গায় প্রতিমা দর্শনের হোর্ডিং যে ভাবে নজর কাড়ছে, বছর দুই আগে দেশপ্রিয় পার্কে যেমন ভিড় হয়েছিল, ততটা যেন না হয়!’’ পুলিশ সূত্রের খবর, পুজোয় এমনিতেই রাস্তায় গা়ড়ির চাপ বেশি। তার উপরে গ্র্যান্ড ফোরশোর রোড বন্ধ থাকলে হাওড়া শহরেই যানজট অনেক বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে তা সামলানোর নির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হবে পুলিশের তরফে। হাওড়া পুলিশ কমিশনারেটের ডিসি (ট্র্যাফিক) জাফর আজমল কিদোয়াই বলেন, ‘‘মাঝগঙ্গায় প্রতিমা দর্শনের জন্য ট্র্যাফিক ব্যবস্থা এখনও ঠিক হয়নি। এ বিষয়ে পুলিশ কমিশনার একটি বৈঠক করবেন।’’