পুরনো চেহারা ফিরে পেল সেন্ট ওলাভ গির্জা

এ যেন টাইম মেশিনে চেপে ইতিহাসে ফিরে আসা। খয়াটে দেওয়াল, জীর্ণ কড়িকাঠ, লঝঝড়ে আসবাব বদলে নতুন ভাবে আত্মপ্রকাশ করল শ্রীরামপুরের সেন্ট ওলাভ গির্জা। ফিরে পেল তার পুরনো চেহারা। পুনরুজ্জীবনের পরে ঐতিহাসিক গির্জাটির উদ্বোধন হল শনিবার। শ্রীরামপুর ছিল ডেনমার্কের উপনিবেশ।

Advertisement

প্রকাশ পাল

শ্রীরামপুর শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৬ ০০:৫৫
Share:

শনিবার উদ্বোধনের পরে। — নিজস্ব চিত্র

এ যেন টাইম মেশিনে চেপে ইতিহাসে ফিরে আসা।

Advertisement

খয়াটে দেওয়াল, জীর্ণ কড়িকাঠ, লঝঝড়ে আসবাব বদলে নতুন ভাবে আত্মপ্রকাশ করল শ্রীরামপুরের সেন্ট ওলাভ গির্জা। ফিরে পেল তার পুরনো চেহারা। পুনরুজ্জীবনের পরে ঐতিহাসিক গির্জাটির উদ্বোধন হল শনিবার।

শ্রীরামপুর ছিল ডেনমার্কের উপনিবেশ। আঠেরো শতকের একটা বড় সময় এই শহরের রাজ্যপাট ছিল ডেনিসদের দখলে। এই সময়ে শ্রীরামপুরে বহু স্থাপত্য গড়ে উঠেছিল। গভর্নমেন্ট কমপাউন্ড, সাউথ গেট, সেন্ট ওলাভ গির্জা, ক্রাউন বাজার (বর্তমান টিনবাজার), উপ-সংশোধনাগার, ড্যানিশ ট্যাভার্ন রয়েছে এই তালিকায়। ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায়, প্রোটেস্ট্যান্ট নাগরিকদের জন্য সেন্ট ওলাভ গির্জার কাজ শুরু হয় শ্রীরামপুরের তৎকালীন গভর্নর ওলি বি-র সময়। সেটা ১৮০০ সাল। বছর কয়েক ধরে সুউচ্চ গির্জাটি মাথা তুলেছিল। একটি সভাঘর, বেদি রয়েছে এই গির্জায়। গির্জার কাজ শেষ হওয়ার আগেই অবশ্য ওলি বী মারা যান। তাঁর কীর্তির সম্মানে গির্জায় একটি স্মৃতিফলকও রয়েছে।

Advertisement

পরবর্তীকালে শ্রীরামপুর কলেজ কর্তৃপক্ষ গির্জাটি তত্বাবধানের দায়িত্ব পান। ২০১০ সাল পর্যন্ত ওই কলেজের ধর্মসভা, সাপ্তাহিক উপাসনার কাজে এই গির্জা ব্যবহার করত। বড়দিনে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হত। কলকাতার ইমানুয়েল মিনিস্ট্রি এখানকার সভাঘরকে শহরের অবহেলিত নাগরিকদের জ‌ন্য স্কুল এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহার করত। কিন্তু কালের নিয়মে ভবনটি কার্যত নষ্ট হয়ে যায়। উইপোকা ছাদের কড়িকাঠের মারাত্মর ক্ষতি করে। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে ‘বিপজ্জনক ভবন’ ঘোষণা করে গির্জাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইতিমধ্যেই ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ডেনমার্ক এ রাজ্যের হেরিটেজ কমিশন এবং রাজ্য প্রশাসনের মধ্যে একটি মৌ স্বাক্ষরিত হয়। সেই অনুযায়ী এই শহরের ডেনিস আমলের স্থাপত্যগুলি পুরনো চেহারা বজায় রেখে আমূল সংস্কারের পরিকল্পনা করা হয়। সেই কাজের অঙ্গ হিসেবেই সেন্ট ওলাভ গির্জাকে পুরনো চেহারায় ফিরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর এই স্থাপত্য পুনঃসংস্থাপনের কাজের সূচনা হয়। জোরকদমে কাজ চলে।

স্থপতিরা জানান, গির্জাটি ১৪ হাজার বর্গফুট জমিতে। গোটা ভবনটিই মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গিয়েছি‌ল। ছাদের বিম উইপোকা নষ্ট করে দিয়েছিল। দেওয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছিল। জানলা-দরজা থেকে আসবাবও জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সংরক্ষণ স্থপতি মণীশ চক্রবর্তী বললেন, ‘‘পুরনো ভবনটি সিমেন্টের ছিল না। চুন-সুরকির ছিল। আমরাও তাই করেছি। কিছু আসবাব মেরামত করা হয়েছে। কিছু আসবাব আনা হয়েছে শ্রীরামপুর কলেজ থেকে।’’ তিনি জানান, এর আগে সংস্কারের সময় কয়েকটি জায়গায় পুরনো নকশা তুলে সমান করে দেওয়া হয়েছিল সিমেন্ট দিয়ে। পুরনো নকশা অনুযায়ী সেই সব জায়গাও চুন-সুরকি দিয়ে মেরামত করা হয়েছে। ভবনের পাশের বাগানটিও বিবর্ণ হয়ে পড়েছিল। সেখানে এখন সুদৃশ্য সবুজ ঘাস। সীমানা প্রাচীরে নতুন রঙের পোচ। সংস্কারের কাজে ২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। পুরো টাকাই এসেছে ওই দেশ থেকে।

আর এ দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতার বিশপ রেভারেন্ড অশোক বিশ্বাস, শ্রীরামপুর কলেজের (গির্জাটির তত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) প্রাক্তন অধ্যক্ষ লালচুংনুঙ্গা, বর্তমান অধ্যক্ষ ভানস্যাংলুরা, ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ডেনমার্কের আধিকারিক বেনটে উলফ-সহ বহু বিশিষ্টজন। ছিলেন হুগলি জেলা পুলিশ-প্রশাসনের আধিকারিকরা। শ্রীরামপুর কলেজের অধ্যক্ষ ভানস্যাংলুরা বলেন, ‘‘এই গির্জায় সব মানুষই আসতে পারবেন। আমরা আলোচনা করে সময়ের ব্যাপারটা ঠিক করব।’’

ইতিহাসবিদরা জানান, পুরনো আমলে সুউচ্চ ওই স্থাপত্যের চূড়া এবং তাতে বসানো ঘড়ি গঙ্গার ওপারে ব্যারাকপুর থেকেও দেখা যেত। কালের নিয়মে ঘড়িটিও অবশ্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই ঘড়িও সংস্কার করা হয়েছে নামি সংস্থা টিআর ক্লকের মাধ্যমে। অনুষ্ঠানের পরে রীতিমতো উচ্ছ্বসিত ডেনিশ মিউজিয়ামের প্রতিনিধি বেনটে উলফ। তিনি বললেন, ‘‘এই কাজটা আমাদের কাছে ধ্যানজ্ঞা‌ন হয়ে গিয়েছিল। এমন সুন্দর ভাবে স্থাপত্যটি পুরনো চেহারা ফিরে পাওয়ায় আমরা সত্যিই ভীষণ খুশি।’’ কলকাতায় ডেনিস দুতাবাসের আধিকারিক স্মিতা বাজোয়িয়া বলেন, ‘‘২০০৭ সাল‌ে এটির ভগ্ন চেহারা দেখেছিলাম। আর আজ এই স্থাপত্যের পুরনো চেহারা দেখে খুবই ভাল লাগছে।’’

দ্বিশতবর্ষ প্রাচীন এই স্থাপত্য তার পুরনো চেহারা ফিরে পাওয়ায় শ্রীরামপুর শহরে যেন উৎসবের আমেজ। ফের ইতিহাসের পাতায় ডুব দেবে এই শহর আর সুদুর ডেনমার্ক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন