মাহেশে রথ থামে গুলির শব্দে

মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের সেবাইতদের অনেকের মুখে ফেরে এই চার স্তবক। প্রাচীনত্ব এবং ঐতিহ্যের নিরিখে পুরীর পরেই মাহেশের স্থান। পুরীর মতোই এখানে বিশ্বাসে ভর করে প্রভুর আশীর্বাদ পেতে কৃচ্ছসাধন করেন বহু মানুষ।

Advertisement

প্রকাশ পাল

শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৮ ১৫:৫৭
Share:

লোকারণ্য: মাহেশের রথে ভি়ড় সামলাতে হিমসিম খেতে হয় পুলিশকে। ফাইল চিত্র

‘‘নীলাচলে পুরুষোত্তম জগন্নাথ নাম।

Advertisement

সেই নাম প্রকট হয় মাহেশের ধাম।।

নিত্য পূজা, নিত্য ভোগ, নিত্য শাস্ত্র পাঠ।

Advertisement

ভক্তজনে জানে তাই মাহেশ শ্রীপাট।।’’

মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের সেবাইতদের অনেকের মুখে ফেরে এই চার স্তবক। প্রাচীনত্ব এবং ঐতিহ্যের নিরিখে পুরীর পরেই মাহেশের স্থান। পুরীর মতোই এখানে বিশ্বাসে ভর করে প্রভুর আশীর্বাদ পেতে কৃচ্ছসাধন করেন বহু মানুষ।

মাহেশের রথযাত্রার বয়স হল ৬২২ বছর। কথিত আছে, ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে জগন্নাথদেবের এক ভক্ত পুরীতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে দেবতার দর্শন না পেয়ে মনোকষ্টে নাওয়া-খাওয়া ভুলেছিলেন তিনি। পরে ভগবানের স্বপ্নাদেশ পেয়ে মাহেশে এসে গঙ্গার ধারে বসেছিলেন। প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝার রাতে গঙ্গায় ভাসমান একটি নিমকাঠ পান ধ্রুবানন্দ। সেই নিমকাঠ দিয়েই জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন।

আরও পড়ুন: পুরীর রথে অতিমানব হয়ে ওঠেন ভক্তেরাই

মাহেশে তখন জনবসতি খুবই অল্প। চতুর্দিক ঝোপ-জঙ্গলে ঘেরা। ধ্রুবানন্দের প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহই আজও পুজো হচ্ছে। সেই সময় জগন্নাথ মন্দির ছিল গঙ্গার ধারে। সেখান থেকেই রথের টান শুরু হত। চলত চাতরায় গুন্ডিচাবাটী (মাসির বাড়ি) পর্যন্ত। পরবর্তী সময়ে গুন্ডিচাবাটী চলে আসে বল্লভপুরে। বর্তমানে মাসির বাড়ি এলাকায় গুন্ডিচাবাটী পর্যন্ত রথযাত্রা হয়।

ইতিহাসের পাতা উল্টোলে জানা যায়, পুরীতে যাওয়ার পথে শ্রীচৈতন্য মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরে এসেছিলেন। পুরীকে বলা হয় ‘নীলাচল’। চৈতন্যদেব মাহেশকে ‘নব নীলাচল’ আখ্যা দেন। শ্রীরামকৃষ্ণও এসেছিলেন মাহেশের রথের মেলায়। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রাধারাণী’ উপন্যাসেও মাহেশের রথের মেলার উল্লেখ আছে।

মাহেশের রথযাত্রার ইতিহাসে প্রথম রথটি তৈরি করে দিয়েছিলেন এক মোদক (মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী)। ১৭৫৪ সালে রথযাত্রায় এসেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হুগলি জেলার দেওয়ান শ্যামবাজারের বসু পরিবারের কৃষ্ণরাম বসু। পরের বছর তিনিই পাঁচটি চূড়াবিশিষ্ট কাঠের রথ তৈরি করে দেন। রথের ব্যয়ভার বহনের প্রতিশ্রুতিও দেন। রথ চলাচলের জন্য মাহেশ থেকে বল্লভপুর পর্যন্ত দেড় মাইল রাস্তাও তৈরি করে দেন। তখন থেকে ওই পরিবারই রথের দায়িত্ব নিয়ে আসছে। সেই রথটি জীর্ণ হয়ে পড়লে কৃষ্ণরামের ছেলে গুরুপ্রসাদ ১৭৯৮ সালে ন’টি চূড়াবিশিষ্ট নতুন রথ বানিয়ে দেন। ১৮৮৪ সালে রথযাত্রার দিন বল্লভপুরে গুন্ডিচাবাটীতে সেই রথটি পুড়ে যায়। বসু পরিবারেরই কর্তা কৃষ্ণচন্দ্রবাবু পরের বছর বর্তমান লোহার রথটি তৈরি করিয়ে দেন।

এই রথটি মার্টিন বার্ন কোম্পানি তৈরি করে। দাম পড়েছিল ২০ লক্ষ টাকা। চারটি তলবিশিষ্ট রথটি লোহার কাঠামোর উপর কাঠ দিয়ে তৈরি। উচ্চতা ৫০ ফুট। ওজন ১২৫ টন। ১২টি লোহার চাকা রয়েছে। এক একটি চাকার বেড় এক ফুট। রথের একতলায় চৈতন্যলীলা, দ্বিতীয় তলে কৃষ্ণলীলা এবং তৃতীয় তলে রামলীলা চিত্রিত আছে। চার তলায় বিগ্রহ বসানো হয়। তামার দু’টি ঘোড়া রথের সামনে লাগানো হয়। কাঠের তৈরি সারথিও থাকে। ১৮৮৫ সাল থেকে এই রথে টান শুরু হয়। জিটি রোডের ধারে বর্তমান জগন্নাথ মন্দিরটি ১৭৫৫ সালে তৈরি করেন কৃষ্ণরামবাবুর বন্ধু, কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার বাসিন্দা নয়নচাঁদ মল্লিক। পুরনো মন্দিরটি গঙ্গাগর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে।

স্নানযাত্রার দিন এখানে ২৮ ঘড়া গঙ্গাজল আর দু’মণ দুধ দিয়ে তিন বিগ্রহকে স্নান করানো হয়। তাতে তিন জনেরই প্রবল জ্বর আসে। তাঁদের সুস্থ করতে কবিরাজ ডাকতে হয়। প্রথা অনুযায়ী আজও আরামবাগ, গোঘাট, ঘাটাল থেকে তিন জন কবিরাজ আসেন। ঈশ্বরকে তাঁরা পাঁচন তৈরি করে দেন। ওই পাঁচন খেয়েই ধীরে ধীরে সেরে ওঠেন জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা। শুশ্রূষা চলাকালীন মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে। রথযাত্রার এক দিন আগে খোলে। ওই দিন রাজা হিসেবে অভিষেক হয় জগন্নাথের। এই অনুষ্ঠানকে এখানে বলা হয় ‘নব-কলেবর’। ‘‘পুরীতে নির্দিষ্ট সময় অন্তর নতুন কাঠ দিয়ে বিগ্রহ তৈরি হয়। ওখানে সেই উৎসবকে নব কলেবর বলে। কিন্তু মাহেশে একই বিগ্রহ যুগ যুগ ধরে পুজো হয়ে আসছে।’’— বলেন জগন্নাথ মন্দিরের প্রধান সেবাইত সৌমেন অধিকারী।

সোজা রথের দিন রথে চাপিয়ে তিন বিগ্রহকে সাড়ম্বরে গুন্ডিচাবাটীতে নিয়ে যাওয়া হয়। মাহেশে গুণ্ডিচাবাটীকে বলা হয় কুঞ্জবাটী বা ‘মাসির বাড়ি’। তবে, ‘মাসি’ অর্থে কিন্তু মায়ের বোন নন, জগন্নাথ আসলে তাঁর সখী পৌর্ণমাসির কুঞ্জে যান। পৌর্ণমাসি থেকেই মাসি কথাটি এসেছে। অসংখ্য ভক্ত খালি পায়ে রশি টেনে রথকে জিটি রোড ধরে মাসির বাড়িতে পৌঁছে দেন। এখানকার মন্দিরটি তৈরি হয় প্রায় ৯০ বছর আগে। তৈরি করেন পাথুরিয়াঘাটারই বাসিন্দা মতিলাল মল্লিকের স্ত্রী রঙ্গমণি দাসী। রথ চালানোর জন্য বিউগল, কাঁসর, ঘণ্টা বাজানো হয়। টান থামানোর জন্য বন্দুক থেকে গুলি ছোড়া হয়।

শুধু রথের রশি নয়, স্নানযাত্রার দিন বিগ্রহদের যে জল-দুধে স্নান করানো হয়, পুণ্যার্জনের জন্য বহু মানুষ তা চরণামৃত হিসেবে পান করেন। রথযাত্রা উৎসবের এক দিন ‘হোড়া পঞ্চমী’ উৎসব হয়। সেই সন্ধ্যায় এলাকার ছেলেরা মশাল ও পালকি নিয়ে জগন্নাথ মন্দিরে আসেন। মন্দিরের ম্যানেজিং সেবাইত অসীম পণ্ডিত জানান, হোড়া পঞ্চমীতে লক্ষ্মীদেবীকে ওই পালকিতে করে মাসির বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। যাতে তিনি জগন্নাথকে সর্ষেপোড়া দিয়ে বশ করে সখীর বাড়ি থেকে ফিরিয়ে নিতে যেতে পারেন। সেই সর্ষেপোড়া সংগ্রহ করার জন্য দূর থেকে ভক্তেরা আসেন।

রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে জিটি রোডের দু’ধারে মেলা বসে। এক সময় গ্রামগঞ্জ থেকে কাতারে কাতারে মানুষ মাহেশে রথের মেলা থেকে কেনাকাটা করতে আসেন। কালের নিয়মে এখন সেই সংখ্যা অনেক কম। কমেছে মেলার পরিধি, জৌলুসও। অবশ্য জগন্নাথ মন্দির থেকে মাসির বাড়ি পর্যন্ত মেলায় দোকানের পাশাপাশি নাগরদোলা থেকে শুরু করে ছোটদের জন্য নানা খেলার আয়োজন থাকে। এখনও অন্তত রথের দিনে পাঁপড় ভাজা বা জিলিপিতে কামড় দেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। সোজারথের ন’দিনের মাথায় হয় পুনর্যাত্রা বা উল্টোরথ।

সম্বৎসর মাহেশে জগন্নাথদেবকে খিচুড়ি-ভোগ, সাদা ভোগ, ভাজা, শাক, অড়হর ডাল, আলুর দম, চাটনি, পায়েস— এই সব দেওয়া হয়। সোজারথ, উল্টোরথ বা বিশেষ দিনে এর সঙ্গে থাকে পোলাও ভোগ, ধোঁকা, ছানার ডালনা, মালপোয়া ইত্যাদি। তবে জগন্নাথের ভোগে সাধারণ নুন থাকে না। বদলে সৈন্ধব লবণ ব্যবহার করা হয়। শেষ পাতে মালপোয়া জগন্নাথের অতি প্রিয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন